
দীর্ঘ নয় বছর পেরিয়ে গেলেও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার সাংবাদিক আবু সায়েম হত্যার বিচার হয়নি। একই সাথে হদিস মেলেনি তার খোয়া যাওয়া ২০ লাখ টাকার। কী কারণে ছদ্মবেশী অস্ত্রধারী যুবক সায়েমকে কুপিয়ে হত্যা করল তার হিসাবও মিলছে না।
২০১৫ সালের ৭ জুলাই সায়েম খুন হওয়ার একদিন পর অর্থাৎ ৯ জুলাই তার স্ত্রী আফরোজা খাতুন বাদি হয়ে রাজীব আহমেদ, সাইফুল ইসলাম শিবলু ও সন্দেহভাজন হিসেবে সামাজুল ইসলামকে আসামি করে জীবন নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তিন আসামি গ্রেফতার হলেও চাঞ্চল্যকর এ হত্যার ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ। পরবর্তীতে হত্যা মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে হস্তান্তর করা হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল আসেনি। তবে গ্রেফতার ওই তিন আসামিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় সিআইডি। বর্তমানে তিন আসামি জামিনে আছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির মারুফ হোসেন জানান, আমি সায়েম হত্যার সঙ্গে জড়িত তিন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন আছে।
একদিকে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও সায়েম হত্যার বিচার না হওয়া অন্যদিকে তার খোয়া যাওয়া ২০ লাখ টাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথাবার্তা ভেসে বেড়াচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের দাবি ২০ লাখ টাকার সাথে হত্যার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
এদিকে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও পিতা হত্যার বিচারের দাবিতে মানবন্ধন করেছেন আবু সায়েমের দুই শিশু সন্তান আবু জুবায়ের রুদ্র ও আবু জাকারিয়া রনক। মানববন্ধনে অংশ নেন জেলার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। ৩০ আগস্ট, শুক্রবার সকালে জীবননগর বাসস্ট্যান্ডে এ মানবন্ধনটি অনুষ্ঠিত হয়।
মানবন্ধনে সাংবাদিক আবু সায়েমের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু জুবায়ের রুদ্র বলেন, প্রিয় জীবননগরবাসী আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে, আমাদের বাবা আবু সায়েম দৈনিক সমকাল পত্রিকার জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা) উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালের ৭ জুলাই রাতে যখন বাবা খুন হন, সেই সময়ে আমাদের দুই ভাইয়ের বয়স ছিল যথাক্রমে মাত্র চার (৪) এবং আড়াই (২.৫) বছর। বাবার আদর, স্নেহ এবং ভালোবাসা বুঝে উঠার আগেই একটি পরিকল্পিত খুনের মাধ্যমে আমাদেরকে পিতৃহারা করা হয়। বঞ্চিত করা হয় পিতার আদর, স্নেহ থেকে। ২০১৫ সালের ৭ই জুলাই রাতে আমাদের নিজ বাড়িতে (পেয়ারাতলা) বাবাকে ছুরিকাঘাত করে খুনি রাজীব সরকার। পরে সে পালিয়ে গেলেও আমাদের জ্যাঠা মেহের আলী মোল্লা (বাবার চাচাতো ভাই) এবং এলাকার সাধারন মানুষ অনেক খোজাখুজি করার পর পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর গ্রাম থেকে আটক করে রাজীবকে পুলিশে সোপর্দ করে।
আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমাদের বাবার মৃত্যুর আগে ব্যাবসা সম্প্রসারণের জন্য নিজ প্রতিষ্ঠানে (খাজা রাইস মিল) জনতা ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা সিসি লোন উত্তোলন করেন, যা আমাদের পরিবার এবং এমনকি বাবার ঘনিষ্ঠজনরাও জানতো। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংকলোন পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে আমাদের মাতা আফরোজা খাতুন এবং আমাদের বড় ভাই মুছা করিম রিপন (চাচাতো ভাই) ব্যাংকে গেলে জানতে পারেন যে, বাবা আবু সায়েম তার জনতা ব্যাংকের ওই সিসি লোনের অ্যাকাউন্ট থেকে তার মৃত্যুর চার মাস আগে (২০১৫ সালের ১২ মার্চ) নিজ হাতে আরো ২০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন, যা আমাদের পরিবারের কেউ জানত না। পরবর্তীতে বাবার রাইস মিলে ধান-চালের হিসাবের সাথে তার আর্থিক লেনদেনের হিসাব অর্থাৎ ব্যাংক লোনের ৩০ লাখ টাকা না মেলায় আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ওই ২০ লাখ টাকাকে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়।
আমাদের বড় ভাই মুছা করিম রিপন (চাচাতো ভাই) বাবার অন্যান্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অনলাইন এবং অফলাইন লেনদেনের খোজখবর নিয়েও যখন ওই নিখোজ ২০ লাখ টাকার কোন হদিস পায়না তখন আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সন্দেহ আরো বাড়তে থাকে। এই টাকার সাথে বাবার হত্যার কোন সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেটা প্রশ্ন জাগে।
খুনি রাজিব সরকার ধরা পড়া পরবর্তীতে বাবার হত্যা মামলার তদন্ত চলাকালীন জীবননগর থানা পুলিশসহ অন্যান্য তদন্ত সংস্থাকে বাবার ওই নিখোজ ২০ লাখ টাকার বিষয়টা জানানো হলেও তারা টাকার বিষয়টাকে তুলনামূলক হালকাভাবে নিয়েছিল। খুনি ধরা পরায় পুলিশসহ অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা ওই নিখোজ ২০ লাখ টাকার বিষয়টাতে কম গুরুত্ব দিয়ে বরং খুনির মুখ থেকে তথ্য বের করার চেষ্টা করেছিল, যদিও রাজিব সরকারের মুখ থেকে এই খুনের পেছনের রহস্য কী সেই তথ্য উদঘাটন করতে তদন্তকারী সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়েও কার্যকর তথ্য (মাস্টারমাইন্ড সম্পর্কে) কেন বের করা গেলোনা এটা নিয়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এবং জনমনেও প্রশ্ন আছে।
বাবা আবু সায়েমের ঘনিষ্ঠ অনেকের মতে, এই মামলার তদন্তে হয়তো কোন অদৃশ্য চাপ ছিলো, যার কারনে আমাদের বাবার প্রকৃত খুনি (মাস্টারমাইন্ড) আড়ালেই থেকে যায় এবং খুনের পেছনের রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।
যেহেতু আমাদের বাবা এই ২০ লাখ টাকা তার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেননি, কোন জমি-জায়গাও কেনেননি, আবার টাকাগুলো তার অন্য কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও লেনদেন হয়নি, সেহেতু আমাদের ধারণা এতগুলো টাকা হয়তো জীবননগরেই (চুয়াডাঙ্গা) বাবার ঘনিষ্ঠ কারো সাথে তিনি হাতে হাতে লেনদেন করেছিলেন। তাই আমরা দুইভাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হলে আমাদের বাবা হত্যার মাস্টারমাইন্ড কে ছিলেন সেটা জানতে পারতাম এবং আমরা ন্যায়বিচার পেতাম।
রুদ্র আরও বলেন, আমাদের বাবা সাংবাদিক আবু সায়েম যেহেতু আপনাদের সহকর্মী ছিলেন, তাই আমাদের বিশ্বাস আমরা দুইভাই আপনাদের সন্তানতুল্য। আপনাদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ এই যে, আমাদের বাবার হত্যা মামলার একটি সুষ্ঠু তদন্তে এবং ন্যায়বিচার পেতে আপনারা আমাদের দুইভাই ও আমাদের পরিবারের পাশে থাকবেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করবেন। আমি আপনাদের কাছে আমাদের বাবা আবু সায়েম এর আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া প্রার্থনা করছি, আল্লাহ যেন আমাদের বাবাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন।
বিবার্তা/আসিম/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]