সদরঘাট দুর্ঘটনা: সপরিবার নিহত মুক্তা ছিলেন গর্ভবতী
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪১
সদরঘাট দুর্ঘটনা: সপরিবার নিহত মুক্তা ছিলেন গর্ভবতী
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ঈদের দিন রাজধানীর সদরঘাটে পন্টুনে বাঁধা লঞ্চের রশি ছিঁড়ে দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তাদের মধ্যে এক দম্পতি ও তাঁদের তিন বছরের একমাত্র সন্তান রয়েছে। নিহতরা হলেন মো. বেলাল (৩০), তাঁর স্ত্রী মুক্তা (২৬) এবং তাঁদের তিন বছর বয়সী মেয়ে মাইসা।


অন্য দুজন হলেন রবিউল (১৯) ও রিপন হাওলাদার (৩৮)। রিপন হাওলাদারের বাড়ি পটুয়াখালী। তিনি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় থাকতেন। আর রবিউলের বাড়ি ঠাকুরগাঁও।


সপরিবারে নিহত মুক্তা সাড়ে ৬ থেকে সাত মাসের গর্ভবতী ছিলেন বলে জানিয়েছেন তার আত্মীয়রা। তারা বলছেন, বেলাল পারিবারিকভাবে অস্বচ্ছল ছিলেন। তার বাবা নেই। পোশাক কারখানার স্বল্প বেতনের কর্মী ছিলেন বেলাল। বেলাল-মুক্তা দম্পতির সংগ্রামী জীবনে স্বাবলম্বী হতে চাকরির পাশাপাশি স্ত্রীকে নিয়ে ব্যবসায়ও শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ায় ব্যবসা আপাতত বন্ধ রেখে স্ত্রীকে গ্রামে রেখে আসতে চেয়েছিলেন বেলাল। তাই ভিড় এড়িয়ে রওয়ানা করেছিলেন ঈদের দিন।


সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বেলাল সিদ্ধান্ত নেন, স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবেন। ঈদের আগে ছুটি পেলেও স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে ঈদের আগে হুড়োহুড়ির মধ্যে তিনি ঢাকা ছেড়ে যাননি। ভেবেছিলেন, ঈদের দিন লঞ্চে ভিড় কম থাকবে। সে জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও একমাত্র আদরের মেয়েকে নিয়ে ঈদের দিন গ্রামে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে দুপুরের দিকে সদরঘাটে পৌঁছান তিনি। এরপর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া যাওয়ার উদ্দেশে বেলা দুইটার পর লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশ করেন তাঁরা। সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনে লঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন বেলাল, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। তখন ১১ নম্বর পন্টুনের সামনে যাত্রী ওঠানোর অপেক্ষায় ছিল এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি পূবালী-১ নামের দুটি লঞ্চ। হঠাৎ ফারহান-৬ লঞ্চটি তাসরিফের ডান পাশ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। তখন ফারহানসহ তিনটি লঞ্চের প্রায় ১০ মিনিট ধরে ধাক্কাধাক্কি হয়। সেই ধাক্কা লেগে হঠাৎ পন্টুনে বাঁধা এমভি তাসরিফের মোটা রশি ছিঁড়ে যায়। মোটা ওই রশি মুহূর্তের মধ্যে এমভি পূবালী-১–এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেলাল, তাঁর স্ত্রী, সন্তানসহ পাঁচজনকে আঘাত করে। এতে বেলালসহ অন্যরা পন্টুনে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। ঘটনাস্থলে তাঁরা অচেতন হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে পন্টুনে ছড়িয়ে পড়ে। আচমকা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়া যাত্রীরা বেলালদের উদ্ধার করে দ্রুত পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। এরপর বিকেলে ফোন পান বেলালের স্ত্রী মুক্তার ভগ্নিপতি জহিরুল ইসলাম রাজু। খবর শুনে তিনি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন।


রাজু বলেন, বেলাল গার্মেন্টসের টাইম কিপিং বিভাগে কাজ করতেন। ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সাড়ে ৪ হাজার টাকার বাসায় থাকা বেলালের জীবনটা সংগ্রামের ছিল। মেয়ে মাইশাকে এখনো স্কুলে ভর্তি করাননি। একটা মেয়ে বলে মেয়েটাকে অনেক আদর করতেন বেলাল।


তিনি বলেন, চাকরির ফাঁকে ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছিলেন বাসার কাছেই। সেখানে টেইলার্সের কিছু কাপড়-চোপড় উঠিয়েছিলেন। মুক্তা (বেলালের স্ত্রী) টেইলার্সের কাজ করতে পারতো। মুক্তা গর্ভবতী হওয়ার পর দোকান ছেড়ে দিয়েছিল। মালামাল বাসায় রেখে দিয়েছিল। বাচ্চা হাওয়ার পর আবার দোকান দেওয়ার ইচ্ছা ছিল।


রাজু আরও বলেন, মুক্তা সাড়ে ৬ বা সাত মাসের গর্ভবতী ছিল, এজন্য তাকে বাড়িতে রেখে আসার জন্য রওয়ানা করেছিল। তা না হলে সবার সঙ্গে আগেই চলে যেত।


এদিকে এ ঘটনায় দুই লঞ্চের চালক ও ম্যানেজারসহ পাঁচজনকে আটক করেছে নৌ পুলিশ। আটককৃতরা হলেন- ফারহান লঞ্চের দুই চালক ও ম্যানেজার এবং এমভি তাসরিফের দুই চালক।


১১ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার নৌ পুলিশের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।


তিনি বলেন, সদরঘাটে লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে পাঁচ যাত্রী নিহতের ঘটনায় ফারহান লঞ্চের দুই চালক ও ম্যানেজার এবং এমভি তাসরিফের দুই চালকসহ মোট ৫ জনকে আটক করা হয়েছে।


পুলিশ সুপার বলেন, তাদের আটকের পর ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মামলার পর বিস্তারিত জানানো হবে।


বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জয়নাল আবেদীন জানান, এমভি ফারহান-৬ ও এমভি তাসরিফ-৪ নামের দুটি লঞ্চের রুট পারমিট তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আজগর আলী ও বন্দর শাখার যুগ্ম পরিচালক কবীর হোসেন। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।


বিবার্তা/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com