হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ২১:০৪
হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।


কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজে ৮০ শতাংশ কক্ষই এখন খালি রয়েছে। পর্যটন মৌসুমে অনেকটা পর্যটক শূন্য বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। তবে অবরোধ চলাকালে দিনের বেলায় দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন যথারীতি কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ২০-২২টি ফ্লাইট আসা-যাওয়া করছে।
রাতের বেলায় দূরপাল্লার কিছু বাসও চলাচল রয়েছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-পথেও দুইটি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করছে।


সোমবার ২টি জাহাজে করে হাজার খানেক পর্যটক সেন্টমার্টিন গেছে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের দাবি, গেলো দুই সপ্তাহে কক্সবাজারের পর্যটনের সবখাতে হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।


কয়েক দফা হরতাল ও অবরোধের মধ্যে কয়েকটি স্থানে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে সটকে পড়া ছাড়া সড়ক-মহাসড়কের কোথাও পিকেটিং বা মিছিল দেখা যায়নি। হরতাল ও অবরোধের প্রথমে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের তৎপরতায় আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনারও খবর পাওয়া যায়নি। সরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমার কার্যক্রমও যথারীতি খোলা রয়েছে।


কক্সবাজার শহর থেকে মিনি বাস, মাইক্রোবাস ও সিএনজি ট্যাক্সিসহ অন্যান্য ছোট যানবাহনগুলো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলাচল করছে।


সৈকত পাড়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় পর্যটন মৌসুম। এসময় লাখো পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকে সমুদ্র সৈকত সহ পর্যটন স্পট গুলো। একই সঙ্গে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে জন্য বিপুল সংখ্যক পর্যটক আগমন হয়। এখন পর্যটনের ভর মৌসুম হলেও কক্সবাজারে পর্যটকের খরা চলছে।


রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের কারণে এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। যার দরুন হোটেল মোটেল ও রেস্টুরেন্টসহ সৈকত পাড়ের ফটোগ্রাফার, বিচ বাইক, ওয়াটার বাইক, ঘোড়াওয়ালা ও কিটকট সহ পর্যটন ব্যবসায়ীরা অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছে।


সোমবার (১৩ নভেম্বর) বিকালে সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটা পর্যটক শূন্য কক্সবাজার সৈকত। সৈকতে কিছু লোকজন দেখা গেলেও বেশিরভাগই স্থানীয়। ব্যস্ততা নেই সৈকতের ফটোগ্রাফার, বিচ বাইক, ওয়াটার বাইকচালক ও ঘোড়াওয়ালাদের। একই সঙ্গে বালিয়াড়িতে কিটকটগুলো বেশিরভাগ খালি পড়ে আছে।


সৈকতর সুগন্ধা পয়েন্টে কিটকট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান বলেন, সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়িতে ২০টি চেয়ার রয়েছে। গত ১৫ দিনে হাজার টাকাও আয় করতে পারিনি। হরতাল-অবরোধের কারণে আমাদেরও পেটের ভাত জুটছে না। ফটোগ্রাফার আবুল কালাম জানান, চলতি পর্যটন মৌসুমে অনেকটা পর্যটক শূন্য। হরতাল ও অবরোধের কারণে সৈকতে তেমন পর্যটক আসছেনা। গেলো ২ সপ্তাহ ধরে সৈকতে আসছি কিন্তু তেমন কোন আয় হচ্ছে না। বিচ বাইক চালক করিম উল্লাহ জানান, ঘূর্ণিঝড় হামুনের পূর্বে দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করেছি। বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধের কারণে গেলো দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটক না আসায় আয়ও হচ্ছে না। হরতাল ও অবরোধের ডাক দিয়ে আমাদের পেটে লাথি মারছে বলেও মন্তব্য তার।


সৈকত পাড়ে হাজারো বার্মিজ পণ্যের পসরা সাজিয়ে খালী বসে আছে দোকানদাররা। পর্যটক না থাকায় তাদেরও নেই কোনো ব্যস্ততা। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভর পর্যটন মৌসুমেও নেই ক্রেতা। পর্যটকও নেই, বেচাবিক্রিও নেই। লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিদিন। ছাতা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন দুলাল জানান, ছাতা মার্কেটে ২০০ মতো দোকান রয়েছে। এসব দোকানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বার্মিজ পণ্য বেচাবিক্রি হতো। কিন্তু এখন বেচাবিক্রি একদম নেই বললেই চলে। বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল ও অবরোধে পর্যটক না থাকায় ব্যবসা হচ্ছে না। প্রতিদিনই ৩ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। কক্সবাজারে রয়েছে ৫ শতাধিক হোটেল মোটেল রিসোর্ট গেস্ট হাউস ও কটেজ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে তেমন পর্যটক নেই। ভালো মানের হোটেলগুলোতে ২০ শতাংশ কক্ষ বুকিং রয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপি-জামায়াতের হরতাল ও অবরোধে কক্সবাজারের পর্যটন খাতে প্রতিদিনই শতকোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।


এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা পড়েছে সমস্যায়। কলাতলী সাগরপাড়ের তারকা মানের সিগাল হোটেলের সিইও রুমী জানান, তাদের হোটেলের মাত্র ২০ শতাংশ কক্ষ ভাড়া হয়েছে। চলতি মাসে এভাবেই চলছে।


সী-ক্রুজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-পথে দুইটি জাহাজ চলাচল করেছে এবং সেগুলোতে ৮শ থেকে হাজারো পর্যটক সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়া করছে। সোমবার ২টি জাহাজে করে হাজার খানেক পর্যটক সেন্টমার্টিন গেছে বলেও জানান তিনি।


কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ২০ থেকে ২২টি ফ্লাইট আসা- যাওয়া করছে। এসব ফ্লাইটে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। অবরোধের প্রভাবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়ার কথা জানিয়ে জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ও জেলা জাসদ সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল জানান, কক্সবাজার শহরে পর্যটকের উপর নির্ভরশীল ৫শতাধিক রেস্টুরেন্ট প্রতিদিনই লোকসান গুণছে। অবরোধ চলাকালে পুলিশ প্রহরায় যাতে বাস চলাচল করা যায় সে লক্ষ্যে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ জানান, মৌসুমের শুরুতেই খুবই সুন্দরভাবে পর্যটন ব্যবসা শুরু করেছিলাম। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পরদিন থেকে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল ও অবরোধের কারণে কক্সবাজারের পর্যটনখাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।


দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় কক্সবাজার অনেকটা পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে। যার ফলে কক্সবাজারের পর্যটনের সব খাতে প্রতিদিনই শত কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। শুধু বিমানযোগে ও প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে কিছু পর্যটকের আগমন ঘটেছে। এভাবে হরতাল ও অবরোধ অব্যাহত থাকলে পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পর্যটন খাতের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাবো হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি আর যেন না দেয়। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার জানান, ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল-অবরোধের কারণে কক্সবাজার অনেকটা পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে।


এক কথায় পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে। অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবাসিক হোটেল খাতে দৈনিক ১০ কোটি টাকার অধিক লোকসান হচ্ছে। এছাড়াও রেস্টুরেন্ট খাতে আরো বেশি লোকসান হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা খাত সহ দৈনিক শক কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, দলমত নির্বিশেষে পর্যটন শিল্পের স্বার্থে পর্যটকবাহী দূরপাল্লার গাড়ি যাতায়াত এবং কক্সবাজারকে হরতাল-অবরোধ মুক্ত রাখা হোক।


বিবার্তা/ফরহাদ/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com