রাজধানীর আরেক আতঙ্ক ছিনতাই
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৩, ২২:০০
রাজধানীর আরেক আতঙ্ক ছিনতাই
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। ছুরি, চাপাতি কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এমনকি ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে রাজধানীবাসী। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত এমনকি দিনে-দুপুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ছিনতাইকারীর হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন পুলিশের এক সদস্য।


ঈদের ছুটি শেষে ১ জুলাই সকালে গ্রামের বাড়ি শেরপুর থেকে ঢাকা আসেন পুলিশ সদস্য মনিরুজ্জামান। ট্রেনে করে ঢাকায় পৌঁছে তেজগাঁও রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে কর্মস্থলে ফিরছিলেন তিনি। পথিমধ্যে ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টের সামনে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। মনিরুজ্জামান তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন।


মাসখানেক আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে রিকশায় ফিরছিলেন খন্দকার তোফায়েল নামে এক ব্যক্তি। পথে পেছন থেকে রিকশায় উঠে তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মুঠোফোনটি নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শূন্য পকেট দেখে রিকশা থামান। আশপাশের সবাই তখন বলতে থাকে রিকশার পেছন থেকে লাফিয়ে কাউকে নেমে যেতে দেখেছেন।


দুই মাস আগে কর্মস্থল গাজীপুর থেকে কমলাপুরে আসেন আহসান নামে এক ব্যক্তি। ট্রেন থেকে নেমে দেখতে পান তার মুঠোফোনটি পকেটে নেই। বুঝতে আর বাকি থাকে না, ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে পকেট থেকে ফোনটি নিয়ে গেছে কেউ।


এছাড়া চলন্ত বাস থেকে মোবাইল টেনে নেয়া ও মলম পার্টির দৌরাত্মতো রয়েছেই। মোবাইল ফোন ছাড়াও যাত্রীদের মূল্যবান জিনিস, ব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী ও টানা পার্টির সদস্যরা।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানের পর ছিনতাইকারী ও টানা পার্টি চক্রের সদস্যদের উৎপাত কিছুটা কমলেও নির্মূল সম্ভব হচ্ছে না পুরোপুরি।


রাজধানীতে সারা বছর কমবেশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে এই অপরাধী চক্র তুলনামূলক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। গণপরিবহনে, মার্কেটে, ভিড়ে, ফাঁকা রাস্তায়, ও ঈদের ছুটিতে বাসা ফাঁকা থাকার সুযোগ কাজে লাগায় চক্রের সদস্যরা।


তবে পুলিশ বলছে, প্রতিনিয়ত চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও অনেক ঘটনা থেকে যায় অজানা। কারণ ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনায় থানা পুলিশ পর্যন্ত যায় না। ফলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর ৫০ থানার তথ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে না।


রাজধানীর ৫০ থানায় ২০২০ সালে চুরি-ছিনতাইয়ে এক হাজার ৮৭৫টি মামলা হয়। ২০২১ সালে এক হাজার ৯৮৬টি। ২০২২ সালে এসে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ৩১৬টিতে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম দুই মাস (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ৩১৮টি চুরি-ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে।


রাজধানীর বিমানবন্দর, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা আজমপুর, হাউজবিল্ডিং, আদাবর, শ্যামলী রিং রোড, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, জাকির হোসেন রোড, মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের পশ্চিম পাশের এলাকা, ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন এলাকা, কোতোয়ালি, মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, হাতিরঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর ও ওয়ারী এলাকায় বিভিন্ন অলিগলিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রায় ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন মানুষ।


আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন ছিনতাইয়ের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।


সিএনজি, অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সবকিছু লুটে নেয়া, আবার চলন্ত বাস, সিএনজি, অটোরিকশা থেকে হাত গলিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা বিশেষ কিছু কৌশল অবলম্বন করে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


পুলিশ বলছে, সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা থাকে সবচেয়ে বেশি। আগে থেকে টার্গেট করা ব্যক্তিদের অনুসরণ করে চক্রের সদস্যরা। এরপর টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে নিজে থেকেই কথোপকথন শুরু করে। এরপর নির্জন এলাকা দেখে ওই ব্যক্তির সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। ততোক্ষণে চক্রের অপর সদস্যরাও সেখানে পৌঁছে যায়। এরপর মারধর করে ভুক্তভোগীকে। এর মধ্যেই ছিনতাইয়ের কাজটি তাদের চক্রের কেউ একজন সেরে ফেলে। ছিনতাই কাজে বাধা দিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এসময় পথচারীরা এগিয়ে এলে তাদেরও আঘাত করে পালিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। এছাড়া উবার পাঠাও, সিএনজি চালক ও বিভিন্ন এলাকার কিশোর গ্যাংরা জড়িত ছিনতাই কাজে।


সম্প্রতি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সহকারী প্রযোজক রাকিবুল হাসান। পুলিশ জানিয়েছে এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত দু’জন হামলাকারীর মধ্যে একজন পাঠাও চালক ও আরেকজন ইলেকট্রিশিয়ান। তারা নিজেদের পেশার পাশাপাশি ছিনতাইয়ে জড়িত।


এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। পুলিশ এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। আমরা ঈদের আগেই অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছিলাম। কিন্তু এরপরও দুঃখজনকভাবে বিষয়গুলো ঘটেছে।


পুলিশের ডাটাবেজ অনুযায়ী রাজধানীতে প্রায় ৬ হাজার ছিনতাইকারী রয়েছে। ডাটাবেজে তথ্য থাকলেও ছিনতাইকারীরা কেন বারবার ফিরে আসে- এ প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রত্যেকে গ্রেফতার হয়েছে বলেই আমাদের ডাটাবেজে নাম আছে। আমরা প্রত্যেককে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছি। এরপর আদালতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা জামিনে বের হয়ে আসে।


এক্ষেত্রে আইনের দুর্বলতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম নাজমুস সাকিব বলেন, যেহেতু ৬ হাজার ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ পুলিশ তৈরী করেছে বিষয়টি অবশ্যই পজিটিভ পুলিশিং। আইন অনুযায়ী ছিনতাইয়ের ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছরের জেল আর অর্থদণ্ড। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিহত বা গুরুতর আহত না হলে পুলিশ বিষয়টিকে সেভাবে আমলে নেয় না। পুলিশ যখন চার্জশিট দেয় তখন দেখা যায় ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত ছুরি, কাঁচি, অস্ত্রসহ যেসব যানবাহন ব্যবহৃত হয়, আবার সিসিটিভি ফুটেজসহ সেসব আলামত সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। তখন চার্জশিট এতটাই দুর্বল হয় যে ছিনতাইকারীরা জামিনে বের হয়ে আবার আগের মত তৎপরতা চালায়।


এক্ষেত্রে পুলিশকে দোষারোপ না করে আমাদের চারপাশের পরিবেশটাকেই এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে এখানে কেউ ছিনতাইয়ের মত ঘটনা না ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা, চারপাশ আলোকিত করার ব্যবস্থা করা, পুলিশের যে মনিটরিং সেল রয়েছে সেটি আরও জোরদার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।


তবে এই ছিনতাই প্রতিরোধে সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডাটাবেজ ধরে এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা কাউন্সিলিংয়ের আওতায় আনতে পারি, তাদের জন্য কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি, বাবা-মায়েরা যদি তাদের অনুশাসন আরও বেশি জোরদার করেন তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com