মহাসড়কের ভূমি অধিগ্রহণ, দুই পাশে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:৪২
মহাসড়কের ভূমি অধিগ্রহণ, দুই পাশে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছরের জুন মাসের আগেই আরিচা-(বরঙ্গাইল)-ঘিওর-দৌলতপুর-নাগরপুর টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা হবে সড়কের দুপাশের জমি।


এ খবর পেয়েই অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় এই আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’পাশে রাতারাতি গড়ে উঠছে অসংখ্য স্থাপনা। কয়েকটি দালালচক্র অনুমোদনহীনভাবে নিম্নমানের কাঁচামাল এবং ব্যবহার অযোগ্য পুরানো ও চিকন রড ব্যবহার করে নির্মাণ করছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা।


এতে করে ভূমি অধিগ্রহণের মুল্য বৃদ্ধি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ঘটনায় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত মহাসড়কে নতুন নির্মানাধীন দালান ও অবকাঠামো নির্মানে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ করেছেন টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।


তবে অনেকেই অভিযোগ করেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস করে ঢাকার কতিপয় দালালচক্র জমির মালিকদের টাকা দিয়ে বিপুল পরিমান ক্ষতিপূরণের আশায় এসব স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মান করছে।


টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে আরিচা (বরঙ্গাইল) ঘিওর- দৌলতপুর -নাগরপুর-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প। ৫৮ দশমিক ৫শ কিলোমিটরা দীর্ঘ ও ৩৩ ফুট প্রশস্ত মহাসড়ক উন্নীতকরণের এই প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশে রয়েছে ৪০ কিলোমিটার এলাকা এবং মানিকগঞ্জ অংশে রয়েছে ১৮ দশমিক ৫শ কিলোমিটার।



নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ছয়শ ৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু ভূমি অধিগ্রহণেই ধরা হয়েছে ছয়শ ৯৩ কোটি ৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এই মহাসড়কে দুইটি আরসিসি গার্ডার, ১৫টি পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও ১৯টি নতুন কালভার্ট ও সাতটি কালভার্ট সম্প্রসারণ করা হবে।


২০২২ সালের ১ জানুয়ারি কাজ শুরু হয়ে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্ত এক বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রকল্পটির নির্মাণ কাজই শুরু হয়নি। চলতি বছর থেকেই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে এই মহাসড়ক উন্নীতকরনের কাজ।
মহাসড়ক আইন অনুযায়ী সড়কের দুপাশের অন্তত ১০ মিটার দূরত্বে স্থাপনা নির্মাণের নিয়ম রয়েছে। কিন্ত কেউ নিয়মের তোয়াক্কাই করছে না।


টাঙ্গাইল-আরিচা  প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের সময় সরকার থেকে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ লাভের আশায় মহাসড়কের দুপাশে স্থাপনা নির্মানের হিড়িক পড়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বাড়ি-ঘর, মার্কেট। মহাসড়ক হওয়ার খবর শুনেই বিগত দুই থেকে তিনমাস যাবৎ চলছে এসব স্থাপনা তৈরির কাজ।  এছাড়াও ভূমি উচ্চ মুল্যে ক্রয় বিক্রয় করে ওই মৌজার গড়মূল্য বৃদ্ধি করছে। ফলে ভূমির অধিগ্রহণ মুল্যে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অধিগ্রহণের মুল্যে বৃদ্ধি পেলে অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বৃদ্ধি এবং ভূমি অধিগ্রহণ খাতে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হবে। এতে করে সময়মত প্রকল্প বাস্তবায়ন আটকে যেতে পারে।


এঘটনায় টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবুল হাসেম গত ১৯ জানুয়ারি আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে নতুন দালান ও অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও সড়ক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার পরও প্রায় শতাধিক  স্থাপনার নির্মাণ কাজ চলছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী মহল এসকল স্থাপনা নির্মাণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে বলে জানান এলাকাবাসী।


এছাড়াও ঢাকা থেকে একটি দালালচক্র এসে মহাসড়কের পাশে যাদের বাড়ি রয়েছে তাদের বুঝিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্ধেক টাকা দেওয়ার শর্তে স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করছে।  নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে রাতারাতি গড়ে উঠা এসব স্থাপনার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। কোনো প্রকার নিয়মের তোয়াক্কা না করেই  এসব স্থাপনা নির্মাণের ফলে অধিগ্রহণের সময় আর্থিকভাবে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধিরগতি হওয়ার আশংকা রয়েছে।  


মহাড়কের প্রায় ৩০ কিলোমিটার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কের আটিয়া ইউনিয়নের সিলিমিপুর থেকে শুরু হয়েছে অবৈধ স্থাপনা নির্মান। সিলিমপুর বেবিস্ট্যান্ডে মজনু মিয়া, কেজি স্কুলের পাশে বালু ও ইট ব্যবসায়ী লালচান মিয়া, আজগড় আলী, লিটন মিয়া গত দুই মাসে পাকা দালান নির্মান করেছেন। এছাড়াও সিলিমপুর বেবিস্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে বিশাল দোতলা দালান। ওই দালানের মালিক এনজিও কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। এলাসিন মওলানা ভাসানী ডিগ্রি কলেজের একটু আগে ঠাকইজোড়া এলাকায় রাস্তা ঘেষেই নির্মান করা হয়েছে দোতলা ও একতলা দুটি দালান। ক্ষতিপুরণের টাকার অর্ধেক দেওয়ার শর্তে জয়নাল শিকদারকে ওই দালান নির্মান করে দিয়েছেন নাটিয়াপাড়ার একজন দালাল। তার নাম মৃনাল। ওই  বাড়ির এক গৃহিনী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার শ্বশুরকে দালালচক্রটি  নানাভাবে, বুঝিয়ে দালান করে দিয়েছে।


তারা বলেছে, আপনিও লাভবান হবেন আমরাও লাভবান হব। জমি তো সরকার নিয়ে যাবে। পরে তো কিছু পাবেন না। ওই দালালচক্রটি আলামিন, আনোয়ার, মিলন, বুদ্দু, লিয়াকত হাতেম, সাইফুল, মহব্বত , মজিবুর, এশাদ, নজরুল দানেজ ও আলী হোসেনের জমিতে টাকা দিয়ে পাকা দালান করে দিয়েছে। এলাসিন ঘাটপার এলাকায় যুগল নামের এক ব্যক্তি গত কয়েকদিনে একতলা দালান উঠিয়েছেন। ছানু নামের অপর ব্যক্তি দিয়েছেন বিশাল লম্বা দেয়ালের টিনশেড ঘর। নাগরপুরে মহাসড়কের পাশে  খোরশেদ মার্কেট ও ডাঙ্গা এলাকায় আবিদ ইটভাটার মালিক শহিদ মিয়া ও কয়েকজনে মিলে অন্তত ১০ থেকে ১২টি দোতলা ও একতলা দালান নির্মাণ করেছেন। সহবত ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ইব্রাহিম মিয়া এমপি রোডের মাথায় রাস্তার সাথে  অবৈধভাবে একতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। নির্মাণাধীন ওই ভবনের শ্রমিক জানান, এক মাস আগে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এই ভবন নির্মানের টাকা মেম্বারকে ঢাকার এক ব্যক্তি দিয়েছেন। শুনেছি ক্ষতি পুরনের টাকা পেলে তিনি অর্ধেক নিবেন।
ঠাকইজোড়া গ্রামের ওবায়দুল্লাহ মিয়া বলেন, রাস্তার পাশেই আমার ২০ শতাংশ জমিতে বাড়ি। ঢাকা থেকে কয়েক ব্যক্তি প্রাইভেটকার নিয়ে এসে আমাকে তাগাদা দিচ্ছে। বলছে চাচা আপনার বাড়িতে  দোতলা একটি দালান করে দেই। আপনার কোন টাকা লাগবে না। অধিগ্রহনের টাকা পেলে আপনি পাবেন অর্ধেক আর আমরা অর্ধেক। আমি তাতে রাজি হয়নি।


আটিয়া ই্উনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মল্লিক বলেন, মহাসড়কের জমি অধিগ্রহণের অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের আশায় কিছুদিন ধরে রাতারাতি একতলা থেকে ৪ তলাবিশিষ্ট এসব ভবন নির্মিত হচ্ছে । এতে মহাসড়কের জমি অধিগ্রহণের সময় সরকারের বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে। প্রকৃত জমির মালিকরা একটা নির্দিষ্ট কমিশন পেলেও সরকারের মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেবে জড়িত এসব দালাল চক্রের সদস্যরা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস রয়েছে ঢাকার কতিপয় এসব দালালচক্রের।  কারণ উচ্চ পর্যায় থেকে ক্ষতিপুরণের আশা না পেলে তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে টাকা বিনিয়োগ করতেন না।


টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবুল হাসেম বলেন, ভূমি অধিগ্রহণভুক্ত জমিতে নতুন করে কেউ যাতে অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারে তার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। এছাড়াও ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পুরো মহাসড়কের ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে। নতুন করে যারা স্থাপনা করেছেন সেগুলোর ভিডিও করা হবে। যারা অধিক টাকার আশায় ভবন নির্মাণ করছেন তারা কেউ ক্ষতিপুরণ পাবেন না। 


টাঙ্গাইল  সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহ. আলিউল হোসেন  জানান, প্রকল্প প্রস্তাবের সময় সড়কের পাশের আগের অবস্থা ভিডিও রেকর্ডিং করে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। নতুন করে সড়কের পাশে কেউ স্থাপনা নির্মাণ করলেই সে ক্ষতি পুরণ পাবে না।  চলমান এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেলা ভূমি বরাদ্ধ কমিটির সভায় সিদ্ধান্তের পরই ভূমি অধিগ্রহন শুরু হবে।


বিবার্তা/ইমরুল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com