রাজনীতি
সালতামামি: নির্বাচনের এক বছর আগেই ঘর গোছালো আওয়ামী লীগ
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
সালতামামি: নির্বাচনের এক বছর আগেই ঘর গোছালো আওয়ামী লীগ
মোছা. রোজিনা খাতুন
প্রিন্ট অ-অ+

২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো এক বছর। তবে নির্বাচন প্রস্তুতি হিসেবে এক বছর আগেই তৃণমূল থেকে কেন্দ্র; সবজায়গাতেই নতুন নেতৃত্ব এনে দল সাজিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বছরের শুরু থেকেই ঘর গোছাতে বেশি ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ। তবে বছরের শেষ দিকে এসে রাজপথে কর্মসূচিতেও নামে দলটি।


দলীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তৃণমূলে দল গোছানো কার্যক্রম বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়, যা জুলাই মাস পর্যন্ত চলে। সেসময় মেয়াদোত্তীর্ণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকেন্দ্রিক ব্যস্ততা ছিল দলে। শোকের মাস আগস্টে শোক দিবসের আলোচনার বাইরে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেনি দলটি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে দল গোছানোর পাশাপাশি রাজপথে বিএনপিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে কর্মসূচি পালন শুরু করে আওয়ামী লীগ। বছরের শেষ কয়েক মাস জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবং দলটির জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের এক বছর আগেই সংগঠন গোছানো কার্যক্রম শেষ করে দলটি।



বছরের শেষ দিকে এসে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ও ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের তৎপরতায় কিছুটা অস্বস্তিতে ছিল আওয়ামী লীগ। এসব বিষয় বাদ দিলে সফলভাবে দল গোছান ও বছরজুড়ে নানা মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারায় বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বছর পার করেছে টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।



# ঘর গোছাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ


চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা দেন। এসময় নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি ও দলকে নির্বাচনমুখী করার পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কাজ শুরুর কথা বলেন তিনি। এর আগে গত বছরের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।



সেই সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা দল গোছানোর পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু জন্য নেতাদের নির্দেশনা দেন। এরপর থেকে বেশ জোরেশোরেই মাঠে নামেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূলে দল গোছাতে জেলায় জেলায় প্রতিনিধি সভা, বর্ধিত সভা ও সম্মেলন শুরু করে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এছাড়া সহযোগী সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার কাজও চলে সমানতালে।



ওই সময়ে দলের নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। এর পাশাপাশি ভোট কেন্দ্রভিত্তিক আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে জোর দেয়া হয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ইউনিটভিত্তিক কমিটি গঠন কার্যক্রম শুরু করে বেশ সফলভাবে কমিটি গঠন শেষ করেছে।


দলের দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৩৯টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন শেষ হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি ২৬টি আর মেয়াদোত্তীর্ণ বাকি ১৩টির সম্মেলন হয়নি।


# রাজপথেও সক্রিয়


বছরজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে উত্তাপ কম থাকলেও শেষ দিকে এসে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে রাজনীতির মাঠ। অক্টোবর মাসে থেকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে দুই মাসের কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এছাড়া রাজধানীতেও এলাকা ভিত্তিক কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এসময়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসুচি বাস্তবায়নে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। রাজধানীতে থানা ভিত্তিক শান্তি সমাবেশ কর্মসূচির শুরু করে দলটি। এছাড়া মহামারি করোনার পর ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডের জনসভার মধ্যে দিয়ে সারাদেশে সমাবেশ কার্যক্রম শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


ডিসেম্বর মাসের শুরুতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ধারাবাহিক সম্মেলন করেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও ছাত্রলীগ। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে উত্তপ্ত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। বিএনপির সমাবেশ নয়াপল্টন না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে এ নিয়ে চলে দরকষাকষি। সমাবেশের স্থান নির্ধারণসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজধানীতে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গণমিছিলও উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের রাজনীতিতে। এছাড়া দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিল ছিল ২৪ ডিসেম্বর। নির্বাচনের এক বছর আগে ক্ষমতাসীন দলের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনকে ঘিরে বাড়তি নজর ছিল দেশবাসীর। সফলভাবে সম্মেলন শেষ করায় এবার নতুন নেতৃত্বে নির্বাচন প্রস্তুতি শুরু করবে দলটি।


# ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের তৎপরতায় অস্বস্তি


৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বিএনপির সমাবেশ প্রস্তুতি ঘিরে সহিংসতায় নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকায় ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার খবরে উদ্বিগ্ন এবং আইনের শাসনকে সম্মান জানাতে এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এর আগে ৭ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকাস্থ ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়েও বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায়। এরপর ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতে বেশ অশ্বস্তিতে পড়ে আওয়ামী লীগ।


# নজর ছিল বাইরেও


চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সংলাপে অংশ নিতে ভারত সফর করেছেন সরকার ও আ.লীগের ৩৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল। জানা যায়, তিন দিনের সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পর্যালোচনা ও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরো জোরদার করা নিয়ে আলোচনা হয়।


২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগ এনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের এধরণের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ভাটা পড়ে। পরে এপ্রিলের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে ওয়াশিংটন সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপিসহ দল ও সরকারের প্রতিনিধিগণ।


এরপর মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খানের নেতৃত্বে এই টিম গঠন করা হয়। এছাড়া বছরের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আখতারের গুলশানস্থ বাসায় এসব বৈঠকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও অংশ নেন।


চলতি বছরের ২১ মার্চ দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুনে উদ্বোধন করা হয় নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু, সেপ্টেম্বরে রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ উদ্বোধন, নভেম্বরে চট্টগ্রামের কর্ণফূলী টানেলের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’র দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন, একদিনে একশ’ সেতু ও একশ’ সড়ক উদ্বোধন এবং ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দেশের ইতিহাসের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনসহ বছরজুড়ে নানা প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছর শেষ করতে পারায় বেশ স্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com