শিরোনাম
শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর যৌথ প্রযোজনা?
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২১, ২১:৪৫
শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর যৌথ প্রযোজনা?
শেখ আদনান ফাহাদ
প্রিন্ট অ-অ+

চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতাগুলোকে ধর্ম দিয়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে বোঝার চেষ্টা করছি। ধর্মীয় উপলক্ষ সুযোগ মাত্র, এর পেছনে রয়েছে সুগভীর ষড়যন্ত্র। আমার বিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছে।


মন্দির এবং হিন্দুদের উপর হামলা বাংলাদেশে হলেও দেশে-বিদেশে কারা এসবের ফায়দা লুটছে সেটিও বাংলাদেশের সব মানুষকে বিবেচনায় রাখার অনুরোধ করছি। একই সাথে যারা গ্রেফতার হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং তাদের সাথে দেশ ও বিদেশের নন-মুসলিম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যোগাযোগ কতখানি গভীর সেটিও অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে শেখ হাসিনা-বিরোধী অপরাজনীতির গভীরতা কতখানি হতে পারে সেটি আমরা অনুমানই করতে পারব না।


বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চায় কারা? শেখ হাসিনা-বিরোধীদের তালিকা করুন। তাহলেই কুমিল্লা ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পেছনে কারা জড়িত এর উত্তর পেয়ে যাবেন আশা করি। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ ভাল করছে, এটা যারা মানতে পারেনা সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো তাদেরই যৌথ প্রযোজনা। এই ঘটনাপ্রবাহের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছিলেন, বাংলাদেশ যখনই এগিয়ে যায় তখন দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অনেক পরাশক্তির চাপ সামলে বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। বিএনপি-জামাত, বামদের একাংশ যে করেই হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চান। এমনকি ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে লাশ ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রও প্রকাশ্যে এসেছে। নিকট অতীতে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের কথা আমরা ভুলে যাইনি। শেখ হাসিনার উপর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ বার সন্ত্রাসি হামলা হয়েছে। ২১শে আগস্ট, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই হত্যা করার চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামাত জোট। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শেখ হাসিনার পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছিল বিএনপি-জামাত জোটের পূর্ব-পুরুষেরা।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পরিকল্পনার পেছনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ইতিহাস সচেতন প্রতিটি মানুষই জানেন। ২১শে অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত থাকার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় সেই মামলার রায়ে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্ন করেছিলেন, জনগণ কেন আবার বিএনপি-জামাতকে ভোট দেবে? আমি একটা নতুন প্রশ্ন করছি। ষড়যন্ত্র ছাড়া শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার কী উপায় আছে বিএনপি-জামাত জোটের? ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ অর্থাৎ গত তিনটি নির্বাচনেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। জনগণ এখন বিএনপির ডাকা হরতালেও সাড়া দেয় না। এমনকি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, তারেক রহমানের মা, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে যখন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হল, সাজা দেয়া হল তখন পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট তীব্র আন্দোলন দূরে থাক একটা বড় মিছিল পর্যন্ত করত পারল না। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কয়জন নেতা আমরণ অনশনে গেছেন? আদৌ কেউ গেছে? অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রতিও তাদের স্বাভাবিক আবেগ বা দরদ নেই। বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি এবং ইতিহাস মিথ্যার চাদরে ঢাকা, স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল। সামরিক শক্তির উপর ভিত্তি করে সংগঠন করলে সেটি রাজনৈতিক দল হয়ে যায় না। এইরকম একটি অরাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল দীর্ঘদিন। বিএনপির প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীর নাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।


২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিএনপি জেতে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার সম্মিলিত শক্তিতে। আওয়ামী লীগের বিরোধী কারা? স্বাধীনতা-বিরোধী জামাত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কুশিলব জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্ম-বিরোধী চৈনিক বাম, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় বঙ্গবন্ধু-বিরোধী বাম ইত্যাদি গোষ্ঠীর সমর্থকগণই যে কোনো মূল্যে গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনার পতন-প্রয়াসে মত্ত। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের শক্তিতে এ অঞ্চলের নিপীড়িত মানুষকে একটা মানবিক রাষ্ট্র উপহার দেয়া আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারীদের তালিকা তাই বৈচিত্র্যপূর্ণ। অতি প্রতিক্রিয়াশীল জামাত যেমন আওয়ামী লীগ-বিরোধী, অতি প্রগতিশীলরাও আওয়ামী লীগ-বিরোধী। জামাত প্রমাণ করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ ‘ইসলামবিরোধী’ অন্যদিকে অতি প্রগতিশীলরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ ধর্মাশ্রয়ী। এমন একটি আপাত-বিরোধী কিন্তু ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত রাজনৈতিক বিরোধিতার রসায়নে যদি ধর্মের ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করা যায় তাহলেই তো খেলা জমে যায়! পূজার এই উৎসবমুখর সময়ে এই ট্রাম্পকার্ডই ব্যবহার করছে শেখ হাসিনা-বিরোধীরা।


কুমিল্লার মন্দিরে দেবতার পায়ের কাছে কোরআন শরীফ কে বা কারা রাখতে পেরেছিল? একটা প্রশ্ন হল কে বা কারা রেখেছিল? আরেকটি প্রশ্ন হল কিভাবে রাখতে পেরেছিল? আমার এখনো বিশ্বাস হয় না যে, মন্দিরে দেবতার পায়ের কাছে কেউ মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ রাখতে পারে! প্রকৃত মুসলমান বা প্রকৃত হিন্দু কেউই এই কাজ করবে না। কারণ একজন সাধারণ ও স্বাভাবিক মুসলমান দেবতার পায়ের কাছে কোরআন শরীফ রাখার কথা ভুলেও কল্পনা করতে পারেনা। একই কথা একজন সাধারণ ও স্বাভাবিক হিন্দুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মন্দিরে দেবতার কাছে একজন হিন্দু কেন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে যাবে?


যদিও ইতিহাসে দেখা গেছে, গিরিশচন্দ্র সেন কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ করেছেন। এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার হয়েছে নন-মুসলিমদের মুসলিম হওয়ার মধ্য দিয়েই। বিজেপির মত কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসনামলেও জাত-পাতের অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য ভারতে হাজার হাজার নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের সবচেয়ে বড় শক্তি হল, এখানে কোন শ্রেণিভেদ নেই। কিন্তু এগুলো ভিন্ন বিষয়। এসবের সাথে দেবতার পায়ের কাছে কোরআন শরীফ রেখে আসার মত ঘটনা তুলনাযোগ্য নয়। খুব খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করা হয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক কাজ ছিল না। একমাত্র তারাই এই কাজ করতে পারে যাদের কাছে ধর্ম বিশ্বাস ও সে মোতাবেক জীবনাচরণ থেকে রাজনীতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম যাদের কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার অবলম্বন তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আলোচনার এখানে আমি এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস সামান্য উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলে প্রথম মামলা দিয়েছিল হিন্দু মহাসভার নেতা সুরেন ব্যানার্জি। অসমাপ্ত আত্মজীবনীগ্রন্থে এই ঘটনা উল্লেখ আছে। ব্রিটিশ আমলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নানাবিধ সাম্প্রদায়িক তৎপরতার শিকার হয়েছিলেন শেখ মুজিব। পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে হয়েছেন পাকিস্তানের অভিজাত মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এই দেশীয় তল্পিবাহক জামাতের দ্বারা। ভারতে জন্ম নেয়া আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, জামাত ইসলাম এবং ব্রিটিশদের সাথে তাদের তাদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে কুমিল্লার ঘটনা এবং এমন সব ঘটনার রহস্য উদঘাটন বাংলাদেশের প্রশাসকদের জন্য সহজতর হবে বলে আমার বিশ্বাস।


উগ্র ওয়াহাবি মতবাদের সমর্থক মাওলানা আবু আলা মওদুদীর ভাবনা থেকে ব্রিটিশ আমলে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪১ সালে ভারতে প্রতিষ্ঠিত জামায়াত থেকে বাংলাদেশে জামায়াতের উদ্ভব। আরএসএস এবং হিন্দুমহাসভার জন্ম-ইতিহাস আরও পুরনো। আরএসএস এর জন্ম ১৯২৫ সালে, হিন্দু মহাসভার জন্ম ১৯১৫ সালে। জামাত, আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা ১৯৪৭ সালে সফল হয়েছিল ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে ফেলতে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের শক্তিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও ঘোষণায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। আর গত ১২ বছর ধরে বাংলাদেশকে উচ্চ থেকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। চলার পথে শেখ হাসিনা ভারত, চীন, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ সব শক্তিকেই সামলে চলেছেন। ভারতের সাথে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি চীনের সাথেও বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নানা খাতে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগের যে কোনো সময়ের চাইতে নিবিড়। ভারত চায় বাংলাদেশকে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের বিনিময়ে হলেও। কিন্তু ক্ষমতায় শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধু হলেন সেই নেতা যিনি ১৯৭২ সালেই মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি ভারতের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। স্বাধীনচেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানগমন ভারত ভালোভাবে নেয়নি।


এরপরের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের অনেকেরই জানা। গত ১২ বছরে ভারতের সাথে বার্গেইন করে শেখ হাসিনার সরকার বিশাল সমুদ্রসীমা আদায় করেছে, ছিটমহল বিনিময়ে সফল হয়েছে, যৌথ নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতে ভারতের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। সীমান্ত হত্যা , ইতিহাস বিকৃতি, গরু, পেঁয়াজ এবং সর্বশেষ করোনা টিকা রপ্তানি বন্ধ, তিস্তার পানি, এনআরসি ইস্যু ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ভারতের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ককে শতভাগ ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ বলার কোনো সুযোগ নেই। ভারতের হাইকমিশনারকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সাক্ষাৎ না দেয়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক ভারত সফর বাতিল, ভারতের অমিত শাহসহ একাধিক মন্ত্রীর মুখে বাংলাদেশ বিষয়ে অপমানজনক শব্দচয়ন এবং বাংলাদেশের মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে কঠোর জবাব প্রদান প্রমাণ করে বাংলাদেশ ভারতের আজ্ঞাবহ নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ বন্ধুত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রেখে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। ২০১৮ সালের ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে।প্রতিদিনের বোমাবাজি গুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।...।‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’ বঙ্গবন্ধুকন্যার এই মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায় ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কতখানি দৃঢ় এবং স্বচ্ছ।


দ্বিপাক্ষিক এই পরিস্থিতিতে ভারতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন দল বিজেপির সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং বাংলাদেশের বিজেপির প্রভাব বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে যখনই হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়, হিন্দুরা নির্যাতিত হয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় বিজেপি। সর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ আগমন এবং সাতক্ষীরায় একটি মন্দির ভ্রমণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের দেশব্যাপী তাণ্ডবলীলার দগদগে ঘা আজও শুকায়নি। হেফাজতের ঘটনার রেফারেন্স দিয়ে ভারতের হিন্দুদের কাছে ভোট প্রার্থনা করে বিজেপি। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পারেনি বিজেপি। ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ভোট সামনেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে কুমিল্লার ঘটনা তদন্তে জামাতের সাথে ভারতের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং তাদের দেশীয় সহচরদের যোগসাজশ আছে কি না সেটি আমার পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব না। এমনকি অনুমান করেও এমন দাবি করা যায় না। কিন্তু তদন্তে সব ধরনের সম্ভাবনা বিবেচনা করেই এগুতে হবে প্রশাসনকে। সরকার নিশ্চয় সব দিক বিবেচনা করে তদন্ত করছে।


একটা তথ্য মনে করিয়ে দিয়ে এই লেখা শেষ করছি। বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনেছিল সংগঠনটির একাংশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দু মহাজোটের প্রতিষ্ঠাতাকালীন মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিকের রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন মহাসচিব উত্তম কুমার দাস। এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, গোবিন্দ প্রামাণিক বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি করায় তারা বিব্রত’। ‘তিনি সর্বদা জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রশংসা করেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কথা বলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও নানা সময়ে কটূক্তি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। ‘সম্প্রতি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ এমন উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অভিযোগও রয়েছে। হিন্দু মহাজোটের নানা কর্মসূচিতেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লোকজন এসে উপস্থিত হতেন। ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি -এনআরসি, রাম মন্দির ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি করায় গোবিন্দ প্রামাণিক ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছেন’ বলে অভিযোগ করা হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।


উত্তম দাস সেদিন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে কাজ করছে, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। সংগঠনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিক সরাসরি যুক্ত বলে লোকশ্রুতি রয়েছে। ফলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা নানা ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে ও প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। যদিও এ সংগঠন কারও তাবেদারি করবে না, এমন প্রতিশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে গোবিন্দ প্রামাণিককে ডেকে আনা হয় জানিয়ে উত্তম দাস আরও জানিয়েছিলেন, সেখানে গোবিন্দ প্রামাণিক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ‘জবাব দিতে পারেননি। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হিন্দু মহাজোট নেতা তারক পদ রায়, বিমল কৃষ্ণ শীল, রাম কৃষ্ণ বিশ্বাস, হেমন্ত কুমার দাসকে নিয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দেশের হিন্দু কমিউনিটির একাংশের নেতা গোবিন্দ প্রামাণিক আসলে কে? কী তার রাজনৈতিক পরিচয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ, গবেষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। গোবিন্দ প্রামাণিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের সাম্প্রদায়িক এবং চরমপন্থি তৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ড. মুনতাসির মামুন।


২০১৬ সালের ২০ জুন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এক লেখায় তিনি লিখেছিলেন, “এই গোবিন্দ প্রামাণিক কে? তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। গোলাম আযম জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গোবিন্দ তাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। সে সময়ের পত্র-পত্রিকা দেখুন। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন চলাকালীন ভায়োলেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই এসব কাজ করছে এবং দায় চাপাচ্ছে জামায়াতের ওপর। তিনি যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন, তা অনেক পত্রিকাই ছাপেনি। প্রথম আলো বড় শিরোনামে তা প্রকাশ করলেও, পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। এ মিথ্যাচার হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করা, সংখ্যাগরিষ্ঠকে অপবাদ দেয়া এবং দাঙা লাগানোর প্রচেষ্টা”।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীসহ জঙ্গি সংগঠনসমূহের সবসময়ের টার্গেট অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিচার দাবি করার দুঃসাহসও দেখিয়েছে এই বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট। হিন্দিতে লেখা ব্যানারে এই জোট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে “বিভ্রান্তিমূলক, মিথ্যা, মানহানিকর তথ্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে সে বছর ২৭ জুনের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার” আহ্বান জানিয়েছিল। তা না হলে অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিচার করার হুমকিও দিয়েছিল এরা।


যে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতি হয় দেশ ও দশের। যে মানুষ চোখের সামনে তার মন্দির ভাঙ্গতে দেখল, ঘর ভাঙ্গতে দেখল সে কি আর কোনোদিন বাংলাদেশকে ভালোবাসতে পারবে? এই ক্ষতি কি শুধু হিন্দুদের? অবশ্যই না। সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে দেশের সব ধর্মের শান্তিপ্রিয় প্রগতিশীল মানুষ। হিন্দুরা এই দেশ ছেড়ে চলে গেলে ভারতে বিজেপির হিন্দু ভোট বাড়বে। সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে,র‍্যাব দিয়ে সাম্প্রদায়িক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের কঠিন কিন্তু অর্জনযোগ্য পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা থাকলে এর উত্তর পাওয়া যাবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা দিয়েই কেবল বাংলাদেশকে অধিকতর শান্তিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।


যারা বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তারা নিজেরা নিজেদের জিজ্ঞেস করুন, আপনার জীবনে কতখানি ইসলাম বাস্তবায়িত করেছেন? ইসলাম সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ সহবস্থানের কথা বলে। তাহলে এরা কারা যারা হিন্দুদের মন্দিরে হামলা করছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? মন্দিরে হামলাকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। দেশব্যাপী অরাজকতার ফাঁকে মুসলমানদের মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’ তৈরি করা হল আরেক উদ্দেশ্য। ধর্ম অবমাননার কথা বলে দেশের সাধারণ মুসলমানদের খেপিয়ে দিয়ে সরকার পতনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করবে বিএনপি-জামাত জোট। এই ফাঁকে আসামের কোটিখানেক স্থানীয় মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চাইবে বিজেপি সরকার। আসামের প্রায় সব বাঙালি মুসলমানকে বাংলাদেশী বলে প্রমাণের চেষ্টা বিজেপি সরকারের বহুদিনের।


সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দরং জেলায় একটি সুবিশাল শিবমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার পর আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। কোটি খানেক বাঙালি মুসলমানের জন্য তৈরি আছে বড় বড় ডিটেনশন ক্যাম্প। কিন্তু বিজেপির মূল টার্গেট এদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া। ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদেরকেও মায়ানমারে না পাঠিয়ে বাংলাদেশে পাঠাতে চেয়েছে বিজেপি সরকার। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের দৃঢ়তায় সেটা পারেনি করতে। আমাদের আবেগের সুযোগ নিয়ে মায়ানমারের সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত সরকার বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তার পরিণতি কি আমরা ভোগ করছি না? এমন একটা জটিল পরিস্থিতিতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দায়িত্ব অনেক বেশী। দেশী-বিদেশী সাম্প্রদায়িক শক্তির কথায় আত্মঘাতী কাজ না করে ঠাণ্ডা মাথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণকল্পে সকলের কাজ করে যাওয়াই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের একমাত্র পথ। অরাজকতাকারীদের তাই সবাই মিলে প্রতিহত করুন। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশের নানাস্থানে জামাতি মানসিকতার অনেকেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের পদ দখল করতে সক্ষম হয়েছে। এরাও সুযোগমত অরাজকতার আগুনে জ্বালানী সরবরাহ করছে।


বিবার্তা/ইমরান




সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com