কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস দেশের একটি সংঘাত দূর করার জন্যে যদি শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাও নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার দাবি রাখেন।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসকে এবারের নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানে কমিউনিস্ট ফার্ক (রেভ্যুলুশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া) বিদ্রোহীদের সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্যে তাকে এ পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে।
দীর্ঘ ৪ বছর আলোচনার পর সম্পাদিত ওই চুক্তির মাধ্যমে অর্ধশতাধিক বছর ধরে চলা এ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। ফার্ক বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির ব্যাপারে দেশের ভেতর থেকেই শক্ত বিরোধীতা থাকলেও এ চুক্তির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন প্রেসিডেন্ট সান্তোস।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের শান্তি চুক্তির সঙ্গে আমি আমাদের একটি শান্তি চুক্তির স্বাদৃশ্য খুঁজে পাই। তাই ওই ঘটনার বিবরণে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি। বাংলাদেশের তিনটি জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসাবে পরিচিত। জেলাগুলো হলো- খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দারবান।
একটা সময় ছিলো এই এলাকাগুলোতে মানবাধিকার বলে কিছুই ছিলো না। গণতন্ত্র থেকে শুরু করে এই এলাকার নাগরিকদের সকল মৌলিক অধিকার ছিলো উপেক্ষিত। স্বাভাবিকভাবেই এসব এলাকায় বিস্তার করতে থাকে সামাজিক বিশৃংখলা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সামরিক জান্তাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিলো। দুই দশক স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চাকা বন্ধ ছিলো। তাই এই পাব্যর্ত এলাকায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বদা মনোযোগী ছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম সরকার গঠন করলে পার্বত্য এ অঞ্চলগুলোতে শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনার এই উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই সময় পার্বত্য এই এলাকাগুলোতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস ছিলো। প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন অস্থিরতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা এই বিশালসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা নিরাপদ হয়েছে শুধুমাত্র একটি শান্তিচুক্তির মধ্যদিয়ে। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পার্বত্য এলাকা তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়।সমসাময়িক সময়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের এক বিরল অর্জন হিসাবে গণ্য হয়।
এ কারণে শেখ হাসিনার ইউনেস্কো পুরষ্কার প্রাপ্তি ছিলো শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলা যায়, এই চুক্তির ফলে পার্বত্য অঞ্চলে মানুষগুলো বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন খুঁজে পায়।
শান্তি ও মানবাধিকার সুরক্ষায় শেখ হাসিনার আরো একটি বড় অর্জন না উল্লেখ করলেই নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত মেয়াদে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ছিলো মানবাধিকার সুরক্ষার আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
৬৮ বছর দেশের পরিচয়বিহীন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ দেশের নাগরিক পরিচয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছে শুধুমাত্র দেশরত্ন শেখ হাসিনার দুরদর্শী কূটনৈতিক সফলতার মাধ্যমে। এই চুক্তি সম্পাদনের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বমানব গণনায় এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষগুলোর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। দেশের নাম-গোত্রহীন মানুষ গুলো জানতোই না, আসলে তারা কোন দেশের নাগরিক। যেন আপন বসতভূমিতে পরবাসী তারা।
এই মানুষগুলো ফিরে পেয়েছে আপন দেশ, বিশাল আকাশ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আপন পরিচয়, বাঁচার মৌলিক অধিকার। এই ছাড়াও অতীতে দেখা গেছে দারিদ্র্য দূর করণের জন্যে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। অথচ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার সময় এই দেশ দারিদ্র্য থেকে কিভাবে বেরিয়ে এসেছে, তার রেফারেন্স টানলে পরিষ্কার হওয়া যায়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, “দারিদ্র্য হচ্ছে সকল অশান্তির মূল” যে রাষ্ট্রনায়ক দেশে অশান্তির মূল কারণ এভাবে চিহ্নিত করতে পারেন আত্মোপলব্ধি থেকে, আর যাই হোক তাঁর নেতৃত্বে দেশে দারিদ্র্য দির্ঘস্থায়ী হতে পারে না এবং তা সত্য ও প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক অগ্রগতি এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশের এই অর্জন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান কিংবা ভুটানের চেয়েও প্রশংসনীয়।
বিশ্বব্যাংকের আরো একটি প্রতিবেদন আমাদের আশা জাগায়। গত বছরের ১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। এই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
তাই বলছি, আজ যদি কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস তাঁর দেশের একটি সংঘাত দূর করার জন্যে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রনায়ক, শান্তিকন্যা শেখ হাসিনাও নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার দাবি রাখেন। কারণ তিনি তৎকালীন নানান দল ও মতকে উপেক্ষা করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে দশ লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে ১৬ কোটি মানুষের ছোট এই দেশকে তিনি শান্তিতে রেখেছেন।
যদিও কে না জানে, নোবেল কমিটির একান্ত আস্থাভাজন না হলে, তাদের গলায় সুর মিলিয়ে না চললে যোগ্যতা যতই থাকুক, পুরষ্কার জোটে না। তারপরও বাংলার মানুষ প্রত্যাশা করে শান্তিকন্যা শেখ হাসিনা শান্তিতে নোবেল পাবেন; পাওয়ার দাবি রাখেন।
লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]