
ময়মনসিংহ শহরে পুরোনো যে ভবন ভাঙা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের না হওয়ার কথা বলছে সরকার।
১৭ জুলাই, বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি, অর্থাৎ তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে দাবি করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর সরকারের নজরে এসেছে। আর্কাইভের রেকর্ড পর্যালোচনা করে পুনঃনিশ্চিত হওয়া গেছে, এই বাড়ির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইতোমধ্যে ভবনটি অনেকাংশ ভেঙে ফেলার পর এ নিয়ে সমালোচনার মুখে শহরের হরিকিশোর রোডে অবস্থিত একতলা জরাজীর্ণ এ ভবন ভাঙার বাকি কাজ স্থগিত রাখে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। এখন সেটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের যোগ না থাকায় বৃহস্পতিবার দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তা ভাঙার কাজ পুনরায় শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বাড়িটি নিয়ে সরকারি রেকর্ড পর্যালোচনার পাশাপাশি স্থানীয় প্রত্নতাত্মিক গবেষক, সাহিত্যিক ও গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের বৈঠকের কথাও তুলে ধরা হয় এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
বাড়িটির মালিকানার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কর্মচারীদের থাকার জন্য নিজের ‘শশী লজ’ বাংলোর কাছে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন স্থানীয় জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী।
“জমিদারি ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর এই বাড়ির মালিকানা সরকারের হাতে চলে আসে। সরকার এটাকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। তখন থেকে এটি জেলা শিশু একাডেমির কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।”
শহরের হরিকিশোর রায় সড়কে অবস্থিত জেলা শিশু একাডেমির অধীনে থাকা পুরাতন একটি ভবন ভাঙা শুরুর পর সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, এটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের বাড়ি। ২০০ বছরের পুরোনো একতলা ভবনটি ভাঙায় সমালোচনার মুখে পড়ে শিশু একাডেমি।
ওই সব খবরে বলা হয়, ময়মনসিংহে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরষদের একতলা প্রাচীন বাড়িটি শিশু একাডেমি ব্যবহার করত। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক দিন ধরে বাড়িটি ভাঙার কাজ করছে। ভবনটি নগরীর বিএনপির কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত।
১৯৮৯ সাল থেকে শিশু একাডেমি ভবনটি ব্যবহার শুরু করে। পরিত্যক্ত ও জীর্ণ ভবনটি একাডেমি কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের পর আর ব্যবহার করেনি। সেই থেকে এটি পড়ে রয়েছে। বাড়িটির সামনে একটি ছোট মাঠ রয়েছে।
হরিকিশোর রায় ছিলেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মসূয়ার জমিদার। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, পাঁচ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীকে তার পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী। সুপণ্ডিত জমিদার হরিকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন।
সংবাদমাধ্যমে খবর আসার পর মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাড়িটি সংস্কারে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর তিন দিন পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই ভবনের খাস জমিকে শিশু একাডেমির নামে ‘দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা’ দেওয়ার কথা তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “এই বাড়ির রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করেছে জেলা প্রশাসন এবং রেকর্ড অনুযায়ী এই জমির মালিকানা সরকারের। রায় পরিবারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নাই।
“স্থানীয় নাগরিক ও গণমান্য ব্যক্তিরাও বলছেন, এই জমি ও বাড়ির সঙ্গে রায় পরিবারের কোনো সম্পর্ক নাই এবং এটি বর্তমানে শিশু একাডেমিকে ইজারা দেওয়া। এই বাড়িটি প্রত্নতাত্মিক স্থাপনাও নয়।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “অবশ্য, এই বাড়ির সামনের সড়কের নাম সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পালক পিতা হরিকিশোর রায় সড়ক। হরিকিশোর রায় সড়কে রায় পরিবারের একটি বাড়ি ছিল এবং বহু আগে বিক্রি করার কারণে এটার কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। নতুন মালিক সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
“এখন যে ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, সেটি জরাজীর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যবহারযোগ্য নয়। ২০১৪ সালে য়মনসিংহ শহরে নতুন আরেকটি জায়গায় নেওয়া হয়েছে শিশু একাডেমিকে এবং স্থানীয় সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে বাড়িটি।”
২০২৪ সালের প্রথমার্ধে সেখানে একটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এরপর যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে জেলা প্রশাসনকে পুরোনো, জরাজীর্ণ ভবনটি সরানোর অনুমতি দিয়েছে শিশু একাডেমি। নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৭ মার্চ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিতে দিয়ে জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে জানানো হয়েছে।
বাড়িটি নিয়ে স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের আলোচনার কথাও তুলে ধরা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে প্রখ্যাত লেখক কাঙাল শাহীন বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বলেছেন, জরাজীর্ণ ভবনটি হরিকিশোর রায় কিংবা সত্যজিৎ রায়ের নয়। বাড়িটি রায় পরিবারের মালিকানায় থাকার কথা বলে যে ‘ভুল ধারণা’ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দেন অধ্যাপক বিমল কান্তি দে। স্থানীয় কবি ও লেখক ফরিদ আহমেদ দুলালও নিশ্চিত করেছেন, এটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নাই।
“ময়মনসিংহের শিশুদের কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে বৈঠকে থাকা সবাই এখানে পরিত্যক্ত ভবনটি ভেঙ্গে শিশু একাডেমির জন্য নতুন ভবন নির্মাণে সমর্থন দিয়েছেন এবং আহ্বান জানিয়েছেন কালক্ষেপণ না করে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার।“
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “বৈঠকে যোগ দেওয়া সবাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একমত হয়েছেন, শিশু একাডেমির পরিত্যক্ত ভবনটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের কোনো ঐতিহাসিক বা পারিবারিক সম্পর্ক নাই।
“ময়মনসিহংহের প্রত্নতাত্মিক গবেষক স্বপন ধর বলেছেন, বাড়িটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নয়। সব ধরনের তথ্যগত ও বিস্তারিত রেকর্ড পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ সরকার সব পক্ষকে বিভ্রান্তিকর বা তথ্যগত ভুল বয়ান প্রচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।”
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]