গত ১৮ জুলাই কোটাবিরোধীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ২য় দিন ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পুলিশ বক্স আগুনে জ্বালিয়ে দেয় কোটাবিরোধীরা। সেই আগুনের লেলিহান মেট্রোরেল পর্যন্ত উঠে যায়। এছাড়া মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে কোটাবিরোধীরা। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় স্টেশন দু'টির। তারা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সব কিছু গুঁড়িয়ে দেয়। ওইদিন পল্লবী ও মিরপুর- ১১ নম্বর স্টেশনেও হামলা হয়। পরে নিরাপত্তার স্বার্থে ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আজ (২৮ জুলাই) ১০ দিন হতে চললো মেট্রোরেল বন্ধ। মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় আড়াই লাখের বেশি যাত্রীকে ফিরে যেতে হয়েছে পূর্বের সেই ভোগান্তি আর দুর্ভোগের জীবনে। মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ার পর মিরপুরবাসীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে; সঙ্গে বাড়তি খরচ তো আছেই।
২৮ জুলাই, রবিবার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশন পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, অফিসগামী যাত্রীদের কেউ কেউ দৌড়ে বাসে উঠছেন, কেউ বাইক রাইডারের সঙ্গে দর কষাকষি করছেন, আবার কেউ অটোরিকশায় ঠিক করছেন।
অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে সময় মত অফিসে পৌঁছাতে পারা নিয়ে অস্থিরতা দেখা যায়, এদিন সকালে ঢাকার রাস্তায় যানজটও ছিল অনেক বেশি।
যাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকে তারা স্বস্তির যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। পুরোনো অভ্যাসে ফিরতে কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। তার সঙ্গে অর্থ ও সময় দুইই বেশি লাগছে। সুযোগ বুঝে ভাড়াও বেশি নিচ্ছেন বাসওয়ালারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গণমাধ্যমকর্মী বিবার্তাকে বলেন, আমার অফিস কারওয়ান বাজারে। আমি নিয়মিত মতিঝিল টু কারওয়ান বাজারের যাত্রী ছিলাম। আমার অফিস শুরু হয় তিনটায়। আগে আড়াইটার পরও বের হয়ে সময় মতো অফিসে চলে আসতে পারতাম। এখন এক-দেড়ঘণ্টা আগে বের হয়েও সময়মতো অফিস পৌঁছা কষ্টকর। আবার তার মধ্যে রয়েছে যানবাহন সংকট।
রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিমন বিবার্তাকে বলেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর আগারগাঁও থেকে উত্তরা ক্যাম্পাসে মাত্র একঘণ্টায় যাতায়াত করতাম। কিন্তু সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় মেট্রোরেল স্টেশনের হামলা-অগ্নিসংযোগের পর মেট্রোরেল চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল শনিবার ক্যাম্পাসে যেতে হয়েছে। বাসে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। ক্যাম্পাস থেকে ফিরতে সময় লেগেছে আরও তিন ঘণ্টা। তারমধ্যে নিরাপত্তাজনিত কারণে যান চলাচলের রুট পরিবর্তন হওয়ায় রাস্তায় প্রচণ্ড যানজটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। দিনশেষে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।
মিরপুর পল্লবী থেকে মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী আমির আলীর গন্তব্য মতিঝিল। তিনি বিবার্তাকে বলেন, কম সময়ে অফিস যাওয়ার জন্য তিনি বাইক রাইডারদের সাথে দরাদরি করছেন। পল্লবী থেকে মতিঝিল যেতে অধিকাংশ বাইকার ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা চাচ্ছে। এভাবে যাওয়া-আসা করলে মাস শেষে না খেয়ে থাকতে হবে। তাই শেষ ভরসা বাস। এখন অফিস টাইম। এত মানুষের চাপ, গাড়ি পাওয়া কষ্ট হয়ে যায়। গরমের মধ্যে অসহ্য লাগছে। ২০২২ সালে মেট্রোরেল চালুর পর থেকে এই পথে যাত্রী সংকটে বাসের সংখ্যা কমতে থাকে; এখন যাত্রীর তুলনায় বাস কম হওয়ায় যাতায়াতে চরম ভোগান্তি হচ্ছে বলে জানান আমির আলী।
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেছেন, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে এক বছর সময় লেগে যাবে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক যন্ত্রপাতিই মেরামতযোগ্য অবস্থায় নেই। এগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে।
এদিকে মেট্রোরেলের ক্ষতি নিরূপণে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। এই কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমটিসিএল এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (ইলেকট্রিক্যাল, সিগন্যাল, টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড ট্র্যাক) যুগ্মসচিব মো. জাকারিয়াকে।
এছাড়া ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, মেট্রোরেল স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএল যুগ্মসচিব মো. জাকারিয়া বিবার্তাকে বলেন, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি। ১০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করব।
গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকালে মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মেট্রো স্টেশন ঘুরে দেখেন তিনি। একপর্যায়ে স্টেশনের ধ্বংসলীলা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাকে বারবার অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করতে দেখা যায়।
সরকারের উন্নয়ন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব স্থাপনা মানুষের জীবনকে সহজ করে- সেগুলো ধ্বংস করা আসলে কোন ধরনের মানসিকতা? ঢাকা শহর যানজটে নাকাল থাকলেও মেট্রো স্বস্তি দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মেট্রো স্টেশন যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, মানতে পারছি না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষ যেন নির্বিঘ্নে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারে সেটা সুনিশ্চিত করা হবে। দেশটা যাতে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে সেই চেষ্টাই করবো। এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সেই দেশটা ব্যর্থ হতে পারে না।
বিবার্তা/জবা/রোমেল/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]