আবহাওয়া অধিদফতরের সব রাডারই অকেজো
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৫২
আবহাওয়া অধিদফতরের সব রাডারই অকেজো
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

কয়েক দিন ধরে তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত জনজীবন, বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। কোন সময়ে আবহাওয়া কেমন হবে সেই বিষয়ে আগাম বার্তা দিয়ে থাকে আবহাওয়া অধিদফতর। কিন্তু যে রাডারের মাধ্যমে এ বার্তা দেয়া হয়, সে রাডারই নষ্ট। জাইকার অনুদানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও রংপুরের নষ্ট দুটি রাডার স্থাপন করার কথা। কিন্তু এর আগেই পুরনো সব রাডার নষ্ট হয়ে বিপাকে আবহাওয়া অধিদফতর। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।


আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকা, রংপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও মৌলভীবাজারে পাঁচটি রাডার রয়েছে। ঢাকা ও রংপুরের রাডার দুটি স্থাপন করা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ১৫ বছরে মেয়াদ শেষ হওয়ায় রংপুরে রাডার ইতিমধ্যে অচল। উঁচু ভবন বেশি হওয়ায় রেডিও জ্যামিংয়ের কারণে অকেজো ঢাকার রাডারও। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে আছে সব রাডারের। বিশ্ববাজারে এসব খুচরা যন্ত্রাংশ আর পাওয়াই যাচ্ছে না। ফলে দুটি পুরোপুরি নষ্ট, বাকি তিনটি প্রায় অকেজো।


এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঢাকা ও রংপুরে দুটি রাডার স্থাপনের জন্য জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জাপান সরকার দুটি রাডারের জন্য অনুদান দিতে রাজি হয়। পরে ২০১৫ সালের ২৪ জুন দুই সরকারের মধ্যে একটি অনুদান চুক্তিও হয়। অনুদানের অঙ্ক ছিল ১৮৬ কোটি টাকা।


পরবর্তীকালে ‘ঢাকা ও রংপুরে আবহাওয়া রাডারের উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় আবহাওয়া অধিদফতর। সে সময় ২০৮ কোটি টাকায় প্রকল্পটি হাতে নেয়া হলেও দুই ধাপে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ২৬০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। কিন্তু ২০১৬ সালে হলি আর্টিসানের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে প্রকল্পটিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত অর্থায়ন বন্ধ ছিল। এখন নতুন করে এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।


সম্প্রতি এ প্রকল্পের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাদের পর্যবেক্ষণে প্রকল্পটির নানান অসংগতি উঠে এসেছে। এতে ঝুঁকি ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয়ার সময় পাঁচটি স্টেশনে অন্যান্য রাডার পুরনো হলেও সচল ছিল। তবে নতুন প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান সব রাডার নষ্ট হয়ে পড়েছে।


আইএমইডি বলছে, এ প্রকল্পটি হাতে নেয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু এ রাডারগুলো যে পুরনো, নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, সেগুলো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উঠে আসেনি কেন? তাছাড়া এখন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই পুরনোগুলো সব একসঙ্গে কীভাবে নষ্ট হলো?


বাংলাদেশের রাডারগুলো যে কাজ করে না, তা গত কয়েক বছরের দুর্যোগের পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়। গত কয়েক বছরে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্য দুর্যোগগুলো সবই বাইরের দেশের বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে জেনেছে বাংলাদেশ। পরে সতর্ক অবস্থানে যেতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বড় কোনো দুর্যোগের খবর দিতে পারেনি সাম্প্রতিককালে।


আইএমইডির কর্মকর্তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগের রাডারগুলো নষ্ট হওয়ায় সঠিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ঢাকায় এ প্রকল্পের বাইরের তিনটি রাডারের তথ্য সন্নিবেশ করা সম্ভব হবে না। নতুন দুটি রাডার স্থাপনের মাধ্যমে বর্তমানে অন্য তিনটি রাডার স্টেশনের (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।


সংস্থাটি আবহাওয়া অধিদফতরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে, এজন্য গাজীপুর এবং রংপুরের মতো এস ব্র্যান্ড ডপলার রাডারসহ অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারের রাডার স্টেশনে সংযোজন করা প্রয়োজন।


ঢাকার ভবনটিতে নতুন রাডার স্থাপন করা হলেও ১৫তলা সমান উঁচু ভবনে লিফট না থাকায় ঊর্ধ্বতন আবহাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে ওপরে উঠে রক্ষণাবেক্ষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন আইএমইডি কর্মকর্তারা।


প্রশ্ন হলো, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে কর্মকর্তা না উঠে নষ্ট হওয়া মেশিনের কাজ সারেন কীভাবে। কিংবা সেখানে তারা নিজেরা না উঠে কাকে পাঠান। নাকি কর্মকর্তাদের অবহেলাতেই নষ্ট হয়ে পড়েছে রাডারগুলো।


প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, রাডারের অপারেশনাল ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম জনবহুল নগরীর নতুন নতুন উচ্চ ভবনের কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করার ফলে আবহাওয়া অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তাই এস ডপলার রাডার ব্যবহার করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি।


প্রকল্পটি নিয়ে আইএমইডির, উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে নতুন দুটি রাডার স্থাপনের পরপরই বর্তমানে প্রায় অকার্যকর অন্য তিনটি রাডারের (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করার লক্ষ্যে তিনটি স্থানে নতুন তিনটি রাডার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রায় ১৫-১৭ তলা উচ্চতার রাডার ভবনে লিফট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া। পর্যাপ্তসংখ্যক আবহাওয়াবিদ ও প্রকৌশলী না থাকায় প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব দূরীকরণে দ্রুত জনবল নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।


রাডার যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য না হওয়ায় যন্ত্রপাতিগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি সম্পাদন করার পরামর্শও দিয়েছে সরকারের এ পরিবীক্ষণ সংস্থা। তাছাড়া গাজীপুর একটি জনবহুল নগরীতে রূপ নেওয়ায় নতুন নতুন উচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে রাডারের অপারেশনাল ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে ভবন নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।


রাডারের মাধ্যমে সাধারণত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে আগাম বার্তা দেয়া হয়। এতে সমুদ্রে মাছ ধরা থেকে শুরু করে কৃষকের মাঠেও অগ্রিম সতর্কতা থাকে। এমনিতেই বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। দুর্যোগের বার্তা সবার আগেই জানা প্রয়োজন। কিন্তু যেখানে রাডারই নষ্ট সেখানে আগাম বার্তার জন্য বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে অন্য দেশের প্রযুক্তিগত তথ্যের ওপর।


আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, আমাদের কয়েকটি রাডার নষ্ট রয়েছে। জাপানের তত্ত্বাবধানে এগুলো রিপ্লেস (বদলে নতুন করে স্থাপন) করার কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো রিপ্লেস হবে। রাডারের মাধ্যমে যে তথ্যগুলো নিয়ে থাকি তা এখন অন্যভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com