অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানীর ৫৮ মার্কেট ও শপিংমল: ফায়ার সার্ভিস
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০৮
অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানীর ৫৮ মার্কেট ও শপিংমল: ফায়ার সার্ভিস
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর ৫৮টি মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল। এর মধ্যে কয়েকটি মার্কেট উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনটাই জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি ৯টি নির্দেশনা জারি করেছে।


৩ মার্চ, রবিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর।


ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানায়, ঢাকার ৯টি সুপার মার্কেট ও শপিংমল আগুন দুর্ঘটনার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিতে ও স্বল্প ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৫টি মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল।


ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসাবে আমরা শপিংমল, মার্কেট, বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করছি। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে এনএসআই, ডিজিএফআইসহ অন্যান্য সংস্থাও এসব পরিদর্শনে অংশগ্রহণ করছেন। এই পরিদর্শনের ফলাফল আমাদের জন্য খুব একটা সন্তোষজনক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ করে মার্কেট বা শপিংমল যেখানে বিপুল পরিমাণ লোক উপস্থিত হন; সেই জায়গাগুলো কিন্তু অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে নিরাপদ করতে ভবনের মালিক, দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতিকে যেসব পরামর্শ দেয়া হচ্ছে তারা তা মানছেন না। ফলে মার্কেটগুলো নিরাপদ হচ্ছে না।


উচ্চ ঝুঁকিতে মার্কেট ও শপিংমলগুলো হলো রাজধানীর সিদ্দিক বাজারের রোজনিল ভিন্তা মাকের্ট, সদরঘাটের মায়া কাটারা, একই এলাকার শরিফ মার্কেট, পুরান ঢাকার চকবাজার উর্দু রোডের শহিদুল্লাহ মার্কেট, একই এলাকার শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, টিকাটুলির রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, আনন্দ বাজারে ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা মার্কেট, নিউ মার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেট।


মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো হচ্ছে রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার এলাকার উত্তরা মার্কেট, ডেমরা সারুলিয়ার সালেহা শপিং কমপ্লেক্স ও মনু মিয়া শপিং কমপ্লেক্স, ওয়ারির একে ফেমাস টাওয়ার ও রোজভ্যালি শপিং মল, নিউ মার্কেট এলাকার মেহের প্লাজা, মিরপুর রোডের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার ও নিউ চিশতিয়া মার্কেট, মিরপুর রোডের নেহার ভবন, নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স।


স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় আছে খিলগাঁও তালতলা স্কুটি করপোরেশন সুপার মার্কেট তালতলা, জুরাইন এলাকার বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচা বাজার মার্কেট, একই এলাকার তিলপাপাড়া মিনার মসজিদ মার্কেট, ডেমরা সারুলিয়ার ইসলাম প্লাজা ও কোনাপাড়ার নিউ মার্কেট, ঢাকা দোহারের এ হাকিম কমপ্লেক্স ও লন্ডন প্লাজা শপিং মল, নবাবগঞ্জের শরীফ কমপ্লেক্স, মিরপুর কাফরুলের বাচ্চু মিয়া কমপ্লেক্স ও ড্রিমওয়্যার, মিরপুর ১ নম্বরের এশিয়া শপিং কমপ্লেক্স ও মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্স এবং ফেয়ার প্লাজা, তেঁজগাও শিল্প এলাকার পেপাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড ও বেগুন বাড়ির নাসা মেইনল্যান্ড, মাওলানা মুফতি দীন মো. রোডের জাকারিয়া ম্যানশন, লালবাগের হাজী আব্দুল মালেক ম্যানশন, মিরপুর রোডের চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট।


যেসব কারণে অগ্নিঝুঁকি বিদ্যমান


এসব মার্কেট এবং শপিংমলগুলোর ক্ষেত্রে অগ্নিঝুঁকি বৃদ্ধির যেসব কারণ বিদ্যমান সেগুলোও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এগুলো হলো- বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের সময় নন-ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন হিসাবে তা নির্মাণ করা বা নিয়ম-নীতি না মেনে ভবন তৈরি করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণের পর সেটিতে নকশাবহির্ভূতভাবে এক্সটেনশন করা। ভবনের ভেতরে মালামাল রাখার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত দাহ্যবস্তু বিপুল পরিমাণে সংরক্ষণ করা। মার্কেটের সামনে উন্মুক্ত জায়গা ও দোকানের সামনে প্রশস্ত চলাচল পথ না রাখা। দোকানের নির্ধারিত সীমানার বাইরে নিচে কার্টন আকারে এবং ওপরে ঝুলিয়ে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত মালামাল সংরক্ষণ করা। চলাচলের পথ, রাস্তা, করিডোর, সিঁড়ি, এমনকি বারান্দা পর্যন্ত মালামাল দিয়ে দখল করে রাখা। মার্কেট বা শপিংমলের ভেতরে নিয়ম না মেনে রাতযাপন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধূমপান করা, খোলা বাতি ব্যবহার, মশার কয়েল ইত্যাদি জ্বালানোর প্রবণতা। বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা। মানসম্মত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করা, নির্ধারিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করা। দীর্ঘদিন ধরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা। মার্কেট ও শপিংমলে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষিত লোক সংরক্ষণ না করা এবং প্রাথমিক অবস্থায় দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে, যা দিয়ে অগ্নিনির্বাপণ করতে হবে সে ধরনের অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ইনস্টল না করা। অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির রিজার্ভার সংরক্ষণ না করা।


নিরাপদ করতে করণীয়


অগ্নিঝুঁকি কমাতে ফায়ার সার্ভিস বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে শপিংমল, মার্কেট এবং নিজের বহুতল ভবনগুলোকে নিরাপদ করতে কিছু কাজ করতে হবে। এগুলো হলো মার্কেট বা ভবন নির্মাণের সময় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, যেখানে যেটি প্রযোজ্য তার নিয়ম-নীতি মেনে ভবন তৈরি করা। ভবনের মূল নকশা পরিবর্তন না করা। শুরুতেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদন করানো এবং তার শর্তগুলো প্রতিপালন ও বাস্তবায়ন করা। ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার প্রাথমিক সরঞ্জামাদিসহ সংরক্ষণ করা। অগ্নিনিরাপত্তার জন্য যথাযথ ও কার্যকর এস্টিংগুইসার ব্যবহার ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। সেগুলো পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত লোক সংরক্ষণ করা। নির্ধারিত জায়গার বাইরে মালামাল সংরক্ষণ না করা। সব রাস্তা, সিঁড়ি, করিডোর উন্মুক্ত ও বাধাহীন রাখা। অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং মাঝেমধ্যে মহড়া অনুশীলনের আয়োজন করা।


ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অসাবধানতা অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ। এই অসাবধানতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইন মানার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন-কানুন অমান্য করার প্রবণতা। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ সহ অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে যেসব নিয়মকানুন রয়েছে এগুলোর প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কারণে দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় আমাদের বিপুল পরিমাণে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।


ফায়ার সার্ভিসের এই পরিচালক আরো বলেন, স্বল্পমেয়াদে এই মুহূর্তে এবং এখনই যে বিষয়টিকে বাস্তবায়ন প্রয়োজন তা হলো- প্রত্যেকটি মার্কেট এবং শপিংমলে সম্মিলিতভাবে কিছু লোক রেখে সারারাত মার্কেটের প্রতিটি জায়গা পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করা। এই পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা শুধু নাশকতামূলক কাজ ঠেকানোর জন্য নয়। এখন তাপমাত্রা অত্যধিক, এই বিপুল তাপমাত্রার কারণে কিন্তু দাহ্যবস্তুর ভেতরে জ্বলে ওঠার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে আছে। সতর্ক হওয়ার পরও আগুন লাগবে না-এটি আমরা বলতে পারি না। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সেটিকে নজরে আনা যায়। অগ্নি-দুর্ঘটনার শুরুতেই যদি সেটি নজরে আনা যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে অ্যালার্ট করা যায়, তাহলে কিন্তু শুরুতেই তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লোকজন শুরুতেই তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় নিয়োজিত হতে পারে; এতে শপিংমল এবং মার্কেট বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।


এর বাইরে আরও কিছু করণীয় তুলে ধরেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক। এগুলো হলো- সব মার্কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালাতে হবে। দোকানের বাইরে মালামাল ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। দোকানের বাইরে কার্টনে করে মালামাল স্তূপ করা যাবে না। করিডোর বা রাস্তার সিঁড়িতে কোনো ধরনের মালামাল সংরক্ষণ করা যাবে না।


তিনি বলেন, আমি আশা করব, দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যগণ কিছু লাভের প্রত্যাশায় তাদের পুরো বিনিয়োগকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না। নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য এবং অগ্নিঝুঁকি হ্রাস করার জন্য তারা আমাদের সুপারিশগুলো মেনে চলবেন।


লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, মহড়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহড়া নিয়মিতভাবে করা হলে অগ্নি-দুর্ঘটনার সময় কার কী করণীয় সেটি আগে থেকে ধারণা লাভ করা যায় এবং তখন হুড়োহুড়ির কারণে সময়ক্ষেপণ হয় না, প্রতিটি কাজ সঠিকভাবে অল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।


তিনি বলেন, দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে ফায়ার সার্ভিসকে নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের মালামাল এবং সরঞ্জাম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত উৎসুক জনতার ভিড় ফায়ার সার্ভিসের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এবং অগ্নিনির্বাপণকে বিলম্বিত করে। প্রত্যেককে সচেতনভাবে নিজেদেরই স্বার্থে ফায়ার সার্ভিসকে বাধাহীন কর্মপরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com