অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর
নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১৭:০৮
নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। সবকিছু ঠিক থাকলে ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম দিকে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ অবস্থায় এখনই বাড়ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। এ সব আগ্নেয়াস্ত্র সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা।


বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দেয়া তথ্যমতে- গত মে মাসে সীমান্ত এলাকায় চলতি বছরের সর্বোচ্চ আটটি পিস্তল জব্দ করা হয়। সঙ্গে ছিল ৪০ রাউন্ড গুলি ও আটটি ম্যাগাজিন। যা গত তিন মাসে সর্বোচ্চ। উদ্ধার করা হয়েছে ১০০ কেজি সালফার, সাতটি ডেটোনেটর ও চারটি বিস্ফোরক স্টিক। যা গত ৫ বছরের সর্বোচ্চ।


আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ধারণা- সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হচ্ছে। আর এসব অস্ত্র বাহকদের বেশিরভাগই স্থানীয় সাধারণ মানুষ। তাদের দেয়া তথ্যমতে- এসব অস্ত্রের গন্তব্য ছিল ঢাকা ও দেশের বিভাগীয় শহর।


এমন পরিস্থিতে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ পর্যন্ত যা জব্দ তা থেকেও হয়তো বেশি পরিমাণ অস্ত্র দেশে ঢুকে গেছে। এ কারণে ঢুকে পড়া অস্ত্রগুলো উদ্ধার ও তাদের বাহককে গ্রেফতার করা সম্ভব না হলে সামনে দেশের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।


জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সীমান্তে ৬০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি সাবমেশিনগানও (এসএমজি) রয়েছে। এর আগের ১০ বছরে মাত্র একটি এসএমজি উদ্ধার হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত ২৪০ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ১৮টি ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি- আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ও সদ্য শেষ হওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র। এর কিছু ধরা পড়ছে। আর বড় অংশই হাতবদল হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সেগুলোর কোনোটি আবার বিক্রির সময় বা বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের আগে পরে জব্দ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রতিবেশী দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অস্ত্র পাচারের ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড।


ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বেড়েছে অবৈধ অস্ত্র কেনবেচা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য এ পথ বেছে নিয়েছেন। আবার অনেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্যও এসব অস্ত্র সংগ্রহ করছেন। ডাকাতি ও চাঁদাবাজির জন্যও অনেকে এপথে পা দিচ্ছেন। ভারতীয় এসব এক একটি অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ৮টি বিদেশি পিস্তল ও ১৬টি ম্যাগজিনসহ গ্রেফতার ৫ জনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় ডিবি।


এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান, ওইসময় গ্রেফতার হওয়া আকরুল হোসেন, ইলিয়াস হোসেন, আবদুল আজিম, ফারুক হোসেন ও ফজলুর রহমানের মধ্যে কয়েকজন জামিনে বেরিয়েছেন। এ কারণে তাদের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। কারণ তারা পেশাদার অস্ত্র চোরাকারবারি। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ভারতের তৈরি ৮টি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগজিন, ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে গ্রেফতার আকরুল হোসেন যশোরের শার্শা এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় সে দুই শতাধিক ভারতে তৈরি পিস্তল বিক্রি করেছে। যারা এসব অস্ত্র কিনেছে তাদের একটি তালিকা পেয়েছি। ওই অস্ত্রগুলোর সন্ধান করা হচ্ছে।


সূত্রমতে, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ চক্রের সদস্যরা গত ৫ বছরে অন্তত ২ শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন। বিশেষ করে লকডাউনের আগে তারা ইউপি নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর অন্তত শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছে বলে জানান। অস্ত্র কেনার তালিকায় রয়েছেন যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ইউপি নির্বাচনের সরকারদলীয় সম্ভব্য প্রার্থীরা। ঢাকাকেন্দ্রিকও তারা কিছু অস্ত্র বিক্রি করেছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ঢাকায় বিক্রি হওয়া অস্ত্রগুলো ডাকাতি ও চাঁদাবাজিতে ব্যবহার হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ওইসব ক্রেতাদের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। তবে ঢাকায় বিক্রি হওয়া অন্তত অর্ধশতাধিক অস্ত্রের ব্যক্তি সম্পর্কে তারা কোনো ধারণা দিতে পারেনি। কারণ তাদের কাছ থেকে কিনে নেয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো হাত বদল হয়ে গেছে।


বিজিবির দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাইফেল, রিভলবার ও পিস্তল চোরাচালান বেড়েছে। গত বছর সর্বোচ্চ ৯টি এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত দুটি রাইফেল জব্দ করা হয়েছে। গত বছর পাঁচটি রিভলবার জব্দ করা হয়, যা ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এ বছর শুধু ফেব্রুয়ারিতে একটি রিভলবার ধরা পড়েছে। ক্ষুদ্রাস্ত্রের মধ্যে পিস্তল চোরাচালান হয় সবচেয়ে বেশি। ফলে প্রতি বছর এ অস্ত্র উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জব্দ হয়েছে। ২০১৮ সালের পর থেকে পিস্তল জব্দের পরিমাণ কমতে শুরু করে। ২০১৯ সালে ৩৮ ও ২০২০ সালে ৩৩টি অস্ত্র জব্দ হলেও পরের দুই বছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০এ। এর পাশাপাশি বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্দুকের কদর। ২০২১ সালে জব্দ করা বন্দুক ছিল ৬৪টি, গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯। আর চলতি বছরের পাঁচ মাসে ধরা পড়েছে ৩৮টি বন্দুক। গুলি চোরাচালানের পরিমাণও বেড়েছে। ২০২১ সালে জব্দ করা হয় ২২০ রাউন্ড গুলি, আর গত বছর তা ২৪ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৫৭ রাউন্ড।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা থাকে। বড় দলের প্রার্থীরা মাঠ দখলে রাখতে চান। কেন্দ্র দখল করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা থাকে। সেক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের বড় উপায় অবৈধ অস্ত্র। এ কারণে নির্বাচনের আগে অস্ত্রের চোরাচালান বেড়ে যায়। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব চালান ধরতে পারে না। ফলে নানা কৌশলে তা অপরাধীদের কাছে পৌঁছে যায়।


তিনি বলেন, অস্ত্র কারা আনছে, কারা ব্যবহার করছে, যোগানদাতা কারা সেসব খুঁজে বের করতে হবে। সীমান্তপথে এক পক্ষ অস্ত্র হস্তান্তর করছে, আরেকপক্ষ গ্রহণ করছে, সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু সমতল নয়, পাহাড়েও এখন সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র যাচ্ছে। তারা এসব অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা যে আগামী নির্বাচনি কোনো পক্ষের হয়ে ব্যবহূত হবে না— সেটাও বলা যায় না। তাই অবৈধ অস্ত্রের কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।


এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম বলেন, অস্ত্রসহ সব ধরনের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করছে বিজিবি। ফলে অবৈধ কোনো কিছু পাচারের চেষ্টা করলেই তা ধরা পড়ছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাস ও আগের ১০ বছরে মোট ১ হাজার ২৭১টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করেছে বিজিবি। এর মধ্যে পিস্তল ৫৭৭, রিভলবার ৫১, রাইফেল ১৬, দুটি এসএমজি ও বিভিন্ন ধরনের ৬২৫টি বন্দুক রয়েছে। বিপুল গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৩০২ রাউন্ড গুলি ধরা পড়ে। এরপর সবচেয়ে বেশি গুলি জব্দ করা হয় গত বছর।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com