যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ টিকটক, নিরাপত্তা না স্নায়ুযুদ্ধ?
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:২৪
যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ টিকটক, নিরাপত্তা না স্নায়ুযুদ্ধ?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ব্যবহারকারী হারাতে চলেছে ভিডিওভিত্তিক জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টিকটক। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সরকারি ফোন থেকে ভিডিও শেয়ারিং-এর জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটক ডিলিট করার জন্য সরকারের সকল চাকুরিজীবীকে নির্দেশ দেয়। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের বিলে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও টিকটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে চীন।


নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে সোমবার হোয়াইট হাউজের দেয়া এই নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের দেয়া সব ধরনের ডিভাইস থেকে চীনা মালিকানাধীন এই অ্যাপটি আনইন্সটল করার জন্য ৩০ দিন সময় দেয়া হয়েছে।


কিন্তু কেন টিকটক নিষিদ্ধ করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্টরা? বিশেষ করে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ভূ-রাজনৈতিকভাবে চীনকে মোকাবেলা করাই এর উদ্দেশ্য।


দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের বহু ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে সামাজিক এই প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে।


এছাড়াও আরও যেসব কারণ থাকতে পারে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চীনের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বাণিজ্য যুদ্ধ। প্রায় সময় দেখা যায় এই দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করছে। দুই দেশের প্রেসিডেন্টই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। বাণিজ্য কিংবা ভূ-রাজনৈতিক- উভয় কারণেই বিশ্ব রাজনীতিতে এই দুই দেশের মধ্যে বনিবনা একেবারেই অসম্ভব।


‘৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বজুড়ে একচেঁটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না বললেই চলে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী যে ছিল না সেটা বলা যাবে না। কারণ ওই সময় চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বড় আঙ্গিকে ভূ-রাজনৈতিক লড়াই তথা বাগযুদ্ধ চালিয়ে আসছিল।


সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং কানাডাও সরকারি ডিভাইসে টিকটককে নিষিদ্ধ করেছে।


তীব্র বিরোধিতা চীনের


ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দমন করার জন্য তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের ব্রিফিং করার সময় একথা বলেন চীনা মুখপাত্র মাও নিং, আমরা এই ভুল সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করি।


তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত বাজার অর্থনীতি এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতিমালাকে সম্মান করা, কোম্পানি দমন বন্ধ করা এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্ত, ন্যায্য ও বৈষম্যহীনভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে তার জন্য পরিবেশ তৈরি করা।


তরুণ তরুণীদের কাছে জনপ্রিয় টিকটকের মতো একটি অ্যাপকে ভয় পাওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপারপাওয়ার একটি দেশ তাদের নিজেদের ব্যাপারে কতোটা অনিশ্চিত থাকতে পারে, বলেন তিনি।


নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ


গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশন সামনে রেখে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।


তখন গুতেরেস বলেছিলেন, আমাদের যেকোনো মূল্যে স্নায়ুযুদ্ধ এড়াতে হবে। নতুন করে এ যুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা। সম্ভবত তা হবে আরও বিপজ্জনক এবং সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।


এছাড়া ২০২০ সালের মে মাসে এর ইঙ্গিত দেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে চলমান সম্পর্ককে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে দোষারোপ করেন ওয়াং ই।


তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তি চীন-মার্কিন সম্পর্ককে জিম্মি করছে এবং এই দুই দেশকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।


২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে অকাস চুক্তি হয়। এই চুক্তিকে একবিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।


বলা হচ্ছে, অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ এই নিরাপত্তা চুক্তি চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের জটিল সমীকরণেও ফেলে দিয়েছে এসব দেশকে।


বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপের সঙ্গে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৭২ সালের রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর বা ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতনের পূর্বাপর তুলনীয় হতে পারে। এই প্রতিটি ঘটনাই গোটা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল।


হুমকির মুখে সরকারি তথ্য


সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ম্যানেজমেন্ট ও বাজেটের পরিচালক শালান্ডা ইয়ং সরকারি সংস্থাগুলোকে গোপনীয় তথ্য রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের দেয়া সব ফোন থেকে টিকটক অ্যাপ ডিলিট করতে বলেছেন।


সংস্থাটি বলছে, এই অ্যাপটির কারণে সরকারের স্পর্শকাতর তথ্য যে ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে সেটি মোকাবেলায় এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।


মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস ও বাসভবন হোয়াইট হাউজ, প্রতিরক্ষা দফতর, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড স্টেটসহ সরকারের কিছু কিছু অফিস ইতিমধ্যে তাদের সব ধরনের ডিভাইসে টিকটক অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করেছে।


কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ক্রিস ডিরুশা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যে ডিজিটাল অবকাঠামোর নিরাপত্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই সিদ্ধান্তে সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে।


টিকটক নিষিদ্ধ করে আইন


গত বছরের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন সব ধরনের ফোনে টিকটক অ্যাপের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস হয় এবং এ বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়ার জন্য হোয়াইট হাউজকে ৬০ দিন সময় দেয়া হয়েছিল।


ধারণা করা হচ্ছে যে মার্কিন কংগ্রেসে এখন আরও একটি আইন পাস হবে যাতে জাতীয়ভাবে টিকটক অ্যাপ নিষিদ্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ক্ষমতা দেয়া হবে।


কানাডাতেও সরকারের সব ধরনের ডিভাইসে এই অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা আজ মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।


জাস্টিন ট্রুডোর উদ্বেগ


এর আগে দেশটির প্রধান তথ্য কর্মকর্তা এই অ্যাপটির কারণে জাতীয় নিরাপত্তা কতোটা হুমকির মুখে পড়তে পারে তা পর্যালোচনা করে দেখেন। তিনি রায় দেন যে, এর ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় হুমকির মুখে পড়বে।


এর পরই সরকার তাদের সব ধরনের ডিভাইসে অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।


প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, এই অ্যাপটিকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ রয়েছে।


এটা হয়তো প্রথম ধাপ, এটাই হয়তো একমাত্র পদক্ষেপ যা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন ট্রুডো।


গত সপ্তাহে ইউরোপিয়ান কমিশন এবং ইউরোপিয়ান পরিষদ তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে তাদের ফোন এবং প্রতিষ্ঠানের সকল ডিভাইস থেকে টিকটক অ্যাপ ডিলিট করার নির্দেশ দেয়।


কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে সাইবার-নিরাপত্তার হুমকি থেকে কমিশনকে রক্ষা করা।


টিকটক যা বলছে


ভিডিও শেয়ার করার জনপ্রিয় এই অ্যাপ টিকটকের মালিক চীনা একটি প্রতিষ্ঠান- বাইটড্যান্স। পশ্চিমা কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক কালে এই অ্যাপটির ব্যাপারে ক্রমশই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।


টিকটকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে যে এই অ্যাপটি তার ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে সেসব তথ্য চীন সরকারের হাতে তুলে দেয়। কিছু কিছু গোয়েন্দা সংস্থার উদ্বেগ যে এই অ্যাপটি সরকারি ডিভাইসে ডাউনলোড করার কারণে স্পর্শকাতর তথ্য অন্যের হাতে চলে যেতে পারে।


এসব অভিযোগ অস্বীকার করে টিকটক বলছে যে তারা এই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের তথ্য কখনোই অন্য কাউকে দেয় না। টিকটক বলছে, ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তারা অন্যান্য সোশাল মিডিয়া কোম্পানির মতো একইভাবে কাজ করে।


বাড়ল কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব


টিকটক নিষিদ্ধে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি বিলে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও টিকটক নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের প্রতি আক্রোশ থেকেই টিকটক নিষিদ্ধের পক্ষপাতী যুক্তরাষ্ট্র।


গত ১৩ মার্চ বুধবার মার্কিন নিম্নকক্ষে টিকটক নিষিদ্ধে বিল পাস হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল সিনেটে অনুমোদনের পর ২৪ এপ্রিল জো বাইডেন বিলটিতে সই করেন। এর মধ্য দিয়ে বিলটি আইনে পরিণত হয়।


২০১২ সাল থেকে টিকটকের মালিকানায় রয়েছে বাইটড্যান্স। বেইজিংভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত। যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা ইউরোপেই তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের বিলে সই করার পর চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপক হলো। আগে থেকেই আশঙ্কা করা হয়ে আসছিল যে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ হলে চীনের সঙ্গে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com