
গাজায় চলমান ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ইসরাইলি আগ্রাসনে হত্যার শিকার ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৩৩ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সেখানকার ডাক্তাররা জানিয়েছেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিশুদেরও লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে ইসরাইলি স্নাইপার।
এদিকে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার অবকাঠামোর ক্ষতি আনুমানিক ১৮৫০ কোটি ডলার।
আনাদুলুর খবর থেকে জানা গেছে, বুধবার দেয়া গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, গাজার ইসরাইলি হত্যার শিকার ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৯৭৫ জনে। এসময়ে আহত হয়েছে ৭৫ হাজার ৫৭৭ জন।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় অন্তত ৫৯ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছে। মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছে। কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছতে পারছেন না।
ইসরাইলি স্নাইপারের নিশানা শিশুরা : ৯ জন ডাক্তার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে এই বছর গাজার হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের সাধারণ মূল্যায়ন অনুযায়ী তাদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেওয়া বেশিরভাগ মৃত এবং আহত শিশু হয় আবাসিক এলাকায় ইসরাইলের তীক্ষ্ণ কোনো কিছুর আঘাতের শিকার হয়েছেন অথবা বোমাবর্ষণের ফলে তাদের শরীর পুড়ে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
কোনো কোনো চিকিৎসক বলেছেন, আঘাতের ধরন, অবস্থান এবং ফিলিস্তিনিরা যারা শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন তাদের বিবরণ শুনে তারা বুঝেছিলেন যে, ক্ষতিগ্রস্তরা সরাসরি ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি দল ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বেসামরিক ব্যক্তিসহ শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ এনেছিল, যারা যুদ্ধের সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নয়, বরং তারা আশ্রয় নিয়েছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং ফরেনসিক প্যাথলজিস্টদের উপস্থিতিতে ৮ শিশুর বন্দুকের গুলিতে আহত হওয়ার বর্ণনা এবং ছবি শেয়ার করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
তারা বলেছে যে, শুধুমাত্র বর্ণনা এবং ছবির ওপর ভিত্তি করে গুলি চালানোর নির্মম পরিস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন, যদিও কিছু ক্ষেত্রে তারা ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত গোলাবারুদ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
দক্ষিণ গাজার বিধ্বস্ত ইউরোপীয় পাবলিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে তার শেষদিনের ডিউটি পালন করছিলেন ডাক্তার ফজিয়া আলভি। হঠাৎ তিনি মুখে গভীর ক্ষত এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের টিউব লাগানো নতুন ভর্তি হওয়া দুই শিশুর পাশে থমকে দাঁড়ান। নার্সকে জিজ্ঞেস করেন শিশুদুটির বিষয়ে। নার্স তাকে জানায় যে, তাদের দুঘণ্টা আগে এখানে আনা হয়েছে। তাদের মাথায় গুলি লেগেছে। তাদের বয়স ৭ অথবা ৮ বছর। কানাডিয়ান এই ডাক্তারের হৃদয় ভিজে যায়। এই শিশু দুটিই প্রথম নয়, যাদের আলভি চিকিৎসা করছেন। আলভি বলেন, পাশাপাশি বিছানায় শিশু দুটি সবজির মত নেতিয়ে পড়েছিল। তারাই প্রথম নয়। আমি এর চেয়েও ছোট শিশুদের দেখেছি যারা মাথায় ও ঘাড়ে স্নাইপার শট নিয়ে এসেছে। এমন অনেক শিশুর চিকিৎসা আলভি করেছেন যাদেরকে ইসরাইলি বাহিনীর স্নাইপার টার্গেট করা হয়েছিল।
নিউইয়র্ক সিটি হাসপাতালের একজন নিবিড় পরিচর্যা চিকিৎসক ডাক্তার ভনিতা গুপ্তা। গত জানুয়ারিতে গাজার ইউরোপীয় হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। একদিন সকালে গুরুতর আহত তিন শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে আনা হয়।
তাদের পরিবার গুপ্তাকে বলেছিল যে, শিশুরা একসঙ্গে রাস্তায় খেলছিল, তখন তারা গুলিবিদ্ধ হয়। গুপ্তা বলেন, আমি দেখলাম একটি পাঁচ-ছয় বছরের শিশুর মাথায় গুলি লেগেছে। তাকে সিপিআর দেওয়া হলো এবং মেয়ে শিশুটি মারা গেল। একই বয়সের আরেকটি মেয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তৃতীয় শিশুটির মাথায়ও গুলি লেগেছিল এবং তাকে সিটি স্কানের জন্য পাঠানো হলো।
নাসের হাসপাতালে কাজ করা চিকিৎসকরা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ২০২৪ সালের শুরুর সপ্তাহগুলোতে তারা শিশুসহ অন্তত ২০ জন আহতকে পেয়েছেন তারা সরাসরি ইসরাইলি গুলির শিকার হয়েছেন। এদের একজন ১৪ বছর বয়সী রুওয়া কাদেই। পানি সংগ্রহে গিয়ে খান ইউনিসের হাসপাতালের কাছে ইসরাইলি হত্যার শিকার হয় এই কিশোরি।
ডাক্তাররা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ওই কিশোরীকে হত্যার সময় সেখানে কোনও সংঘর্ষের বাস্তবতা ছিল না। যার মরদেহ সংগ্রহে গেলে তাকেও গুলি করে মেরেছে ইসরাইল।
এদিকে গাজা শহরে ৩ বছর বয়সি এমাদ আবু আল কুরা চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে ফল কিনতে গিয়ে ইসরাইলি স্নাইপারে হত্যার শিকার হয়। হত্যা করা হয় তার ২০ বছর বয়সি চাচাত ভাই হাদেলকেও। পরিবারের দাবি, স্নাইপার দিয়ে তাদের নিশানা করে হত্যা করা হয়েছে।
হাদেলের বাবা হারুন সরাসরি এই হত্যাযজ্ঞ দেখেছেন।
তিনি আলজাজিরাকে বলেন, বেসামরিকদের নিশানা করার বিষয়টা খুবই স্পষ্ট। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই হাদেল আর এমাদকে হত্যা করেছে।
বিবার্তা/লিমন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]