অনুস্বর (ং) আর অনুস্বারের (ং) মাঝে কোনটি শুদ্ধ আর কোনটি অশুদ্ধ তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক রয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে দুটিই শুদ্ধ এবং ব্যাকরণসম্মত। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অনুস্বরকেই শুদ্ধ মনে হতে পারে। অনুস্বরের গঠন হচ্ছে ‘অনু + স্ব + অ (অল)’। অন্যদিকে অনুস্বারের গঠন হচ্ছে ‘অনু + স্ব + অ (ঘঞ)’।
অনুস্বরের পক্ষে ছিলেন হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়। তাঁর বিবেচনায় অনুস্বার অশুদ্ধ। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বিবেচনায় দুটিই শুদ্ধ।
সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলা প্রয়োগ অভিধান’-এ লিখেছেন, ‘কেউ কেউ ঋগ্বেদ, প্রাতিসাখ্য এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর প্রয়োগ অনুসরণ করে অনুস্বার শব্দটিকেই শুধু ব্যবহার্য বলেন।’
বাংলায় অনুস্বার শব্দটি বেশ পুরনো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়রা অনুস্বারের পক্ষে ছিলেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাঙ্গালা বানান সমস্যা’ প্রবন্ধে অনুস্বারই লিখেছেন ‘আমরা বলিব, সরলতার জন্য বাঙ্গালায় কেবল অনুস্বার চালান উচিত’।
অন্যদিকে সৈয়দ মুজতবা আলী তার রম্য প্রবন্ধে মজা করে লিখেছেন, ‘একটা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের বইয়ে পড়েছিলুম, বাংলা শব্দের অন্ত্যদেশে অনুস্বার যোগ করিলে সংস্কৃত হয়; ইংরেজি শব্দের প্রাগদেশে জোর দিয়া কথা বলিলে সায়েবী ইংরেজি হয়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘মুক্তির উপায়’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘দেখুন, আমি মুখখু মানুষ, অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা মন্ত্রর মুখ দিয়ে বেরবে না, কী বলতে কী বলব, শেষকালে অপরাধ হবে।’
তিনি তার ‘যোগাযোগ’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘তাই স্মৃতির পাড়াতেও তাদের এই অপকীর্তনের অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা ঢাকি জুটল।’ আর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রয়েছে ‘সেই বাড়ির মেয়ের শুচি সংস্করণে যাতে অনুস্বার-বিসর্গের ভুলচুক না থাকে সেই চেষ্টায় লাগলেন তাঁর স্বামী।’ বোঝা যাচ্ছে, অনুস্বরের পাল্লা সে তুলনায় ভারি নয়।
এদিকে উচ্চারণে ‘ং’ ও ‘ঙ’র মাঝে ফারাক নেই। বর্ণ হিসেবে অনুস্বার অযোগবাহ বর্ণ। বিসর্গও (ঃ) একই কাতারের। অযোগবাহ বর্ণের ব্যাখ্যায় ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘অন্য স্বর ও অন্য ব্যঞ্জনের সহিত ইহাদের যোগ কল্পিত হয় নাই, ইহারা যেন স্বর ও ব্যঞ্জনমালার বাহিরে অবস্থান করে।’
অনস্বার ও বিসর্গ উচ্চারণের সময় ও পরে কোনো স্বরধ্বনির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু উচ্চারণকালে এই দুই অযোগবাহ বর্ণ শব্দের উচ্চারণে নানা পরিবর্তন ঘটায়।
১৭৬৮ সালে প্রকাশিত হ্যালহেডের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (প্রকাশ কাল ১৮৪৯) পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬টিই ছিল। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯, ৯৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অ, অঃ।
বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২ তে নামালেন। তিনি তাঁর বইয়ের ভূমিকায় লিখলেন ‘বহূকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋৃ-কার ও দীর্ঘ ৯৯ কারের প্রয়োজন নাই। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে।’
বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে মাত্র আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তাহলো ৯ বর্ণটি বাদ দেয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসেছিলেন।
তা ছাড়া বিদ্যাসাগর দেখলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষায় একারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে।’ তাই এটিকেও ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেছেন। আর ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে হয় ‘সুতরাং উহা সংযুক্তবর্ণ, এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।’ এভাবে তাঁর হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া