গাইবান্ধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁসে ইটভাটা, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ১৩:৩৯
গাইবান্ধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁসে ইটভাটা, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা
গাইবান্ধা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

গাইবান্ধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন ঘেঁষেই চলছে ইট পোড়ানোর কাজ। সকল নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে এসব ইট ভাটা। ভাটার চিমনির বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে কমলমতি শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও স্কুলের পাশের রাস্তায় দ্রুত গতিতে চলে অবৈধ ট্রাক্টর। ট্রাক্টরে উচ্চ শব্দে বায়ু দূষন ব্যাপক আকার ধারণ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁসে অবৈধভাবে ইটভাটা গড়ে উঠলেও প্রশাসনের সদিচ্ছার কারণে তা চলছে বছরের পর বছর। গাইবান্ধায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁসে গড়ে উঠার সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক ইটভাটা। ইট ভাটার কালো ধোঁয়ায় শুধু শিক্ষার্থী নয় জনবসতি এলাকায় গড়ে তোলা ভাটার আশপাশের সাধারণ মানুষও পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ফলে প্রতিনিয়তই দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট, এলার্জি, চর্মসহ নানা রোগব্যধি। এছাড়াও ভাটার ধোঁয়ায় গাছের ফল, ফুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ সড়কে ট্রাক্টর ও ট্রলি চলাচলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব দেখার কেউ নেই। তবে অভিযোগ রয়েছে মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। এসব ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধের কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এসব ইটভাটায় যোগান দিতে প্রতি বছর ফসলি জমির টপসয়েল কেটে ব্যবহার করা হচ্ছে । ফলে ঘটছে কৃষকের ফসলহানীর মত ঘটনাও।


সরেজমিনে দেখা গেছে, গাইবান্ধা সদর উপজেলার উজির ধরনীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন গড়ে উঠেছে মেসার্স এআরকে ব্রিকস ও এমজিএম ব্রিকস, কাবিলের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় মেসার্স এএবি ব্রিকস্, কিসামত মালিবাড়ী ধর্মপুর কাবিলের বাজারহাট দাড়িয়াপুর সংলগ্ন এলাকায় কওমি মাদ্রাসা, এতিমখানা, শিশু নিকেতন, কাজলঢোপ বল্লমঝাড় কাজলঢোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় মেসার্স কেএবি ব্রিকস, খামার বল্লঝাড় চক গয়েশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুলসীঘাট ফলিমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে মেসার্স এমকেবি ব্রিকস্ ও খামার বল্লমঝাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁসে রয়েছে মেসার্স আরএসএস ব্রিকস নামে ইটভাটা।


পলাশবাড়ী উপজেলার নুনিয়াগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে গড়ে উঠেছে সেসার্স এমএমবি ব্রিকস ও ছাউনিয়া মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩০০ গজ দুরে নির্মাণ করা হয়েছে মেসার্স শিবলু ব্রিকস্, সাবদিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় মেসার্স শামিম ব্রিকস্ নামে রয়েছে ইটভাটা। গাবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পুনতাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পুনতাউড় নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০০ গজ দুরে গড়ে উঠেছে মেসার্স লিপ্ত এন্ড আরিশা ব্রিকস্।


সাদুল্যাপুর উপজেলার কুঞ্জমহিপুর দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুঞ্জমহিপুর বালিকা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, কুঞ্জমহিপুর বি ইউ উচ্চ বিদ্যালয়, কুঞ্জমহিপুর বালিকা দাখিল মাদ্রাসা ও কুঞ্জমহিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁসে মেসার্স এসআরবি ব্রিকস্, বুজরুক রসূলপুরের কিসামত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মেসার্স শিখা এনএম ব্রিকস্ ও মেসার্স এসএম ব্রিকস্ নামে ইটভাটা।


সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপুর, শ্রীপুরে উত্তর ধর্মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪০০ মিটার দুরে মেসার্স এমআর ব্রিকস্-১, উত্তর শাহাবাজ, সর্বানন্দ এলাকার উত্তর শাহাবাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯০০ মিটার দুরে মেসার্স মা-বাবার দোয়া ব্রিকস্ নামে ইটভাটা।


এছাড়া পলাশবাড়ী উপজেলার সাকোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মেসার্স আলতা ব্রিকস্, মেসার্স এমসিবি ব্রিকস্, মেসার্স মায়া ব্রিকস্, মেসার্স বাদশা ব্রিকস্, মেসার্স বাদশা ব্রিকস্ ও জনতা ব্রিকস্ নামে ৬টি ইটভাটা রয়েছে।


নিয়ম না মানা এসব ভাটা মালিকরা ইট তৈরীতে কৃষি জমির টপসয়েল কেটে ইট তৈরী করছেন। ফলে একদিকে যেমন জমির শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে, অন্যদিকে কমে যাচ্ছে আবাদী জমি। বিভিন্ন এলাকায় কৃষক নিয়ম না মেনে জমির শ্রেনি পরিবর্তন পুকুর খনন করে ভাটা মালিকদের কাছে মাটি বিক্রি করছেন। এতে করে শস্যহানী, ঘাতক পদার্থে মরচে সৃষ্টি, ভূমিক্ষয়, ভূমিধস ও ভূমির ঊর্বরতা হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সাথে পরিবেশের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে, যা আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যৎ ডেকে আনতে পারে।


এসব ইট পোড়ানোর কারণে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ছাই, ধূলা ও সালফার-ডাই-অক্সাইডসহ ক্ষতিকর গ্যাস। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষ, গবাদীপশু, গাছপালাসহ কৃষি ফসলী জমি।
কুঞ্জমহিপুর দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছা. সেলিনা আক্তার বলেন, স্কুল ঘেঁসে ইটভাটা। এরপর রাস্তার সঙ্গেই স্কুলটি হওয়ায় প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ। স্কুল নিতে অনেক কষ্ট হয়। শিক্ষার্থীরদের পড়ায় মন বসে না। এছাড়া ধূলা-ধোঁয়ার কারণে শিশুদের চর্ম, এলার্জি রোগ বালাইসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এসে জরিমানা করেছেন। কিন্তু ভাটা তো এখনো বন্ধ হয়নি ।


মেসার্স এসআরবি ব্রিকস ইটভাটা ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম জানান, গেল কয়েকদিন আগে সাত লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। লোকসান পুষিয়ে নিতে ভাটা চালু রেখেছি।


এমএমবি ব্রিকস্ ভাটার ম্যানেজার মাহমুদ জানান, প্রশাসন থেকে অভিযান চালিয়ে ৮ লাখ টাকা জরিমানাসহ ভাটার আগুন নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল। লোকসান হলেও আবারো ঠিকঠাক করে ভাটা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি । জেলার ইটভাটার তালিকা অনুযায়ী গাইবান্ধায় ইটভাটা রয়েছে ১৭৩টি। লাইসেন্সকৃত ভাটা ১৮টি। এরমধ্যে বন্ধ রয়েছে ৪০টি। তবে বন্ধের তালিকার সাথে সরেজমিনে কোন মিল পাওয়া যায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে যাচ্ছি। পরিকল্পনা অনুয়ারী পর্যায়ক্রমে সব অবৈধ ভাটা গুলোতে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।


এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত জেলায় ১১ বার মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। এতে ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। সেইসাথে অনুমোদন না থাকায় বেশ কয়েকটি ইটভাটা ইতিমধ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আরও অবৈধ ইটভাটায় আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।


বিবার্তা/আনোয়ার/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com