অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ভোগান্তির আরেক নাম ব্যানবেইস!
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ১০:০০
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ভোগান্তির আরেক নাম ব্যানবেইস!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

কেউ কাগজপত্র গোছাতে ব্যস্ত, কেউ এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছেন, আবার কেউবা ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন, কেউ কেউ নিজেদের মাঝে খোশগল্প করছেন। তবে তাদের গল্পের বিষয় সুখের নয় বরং দুঃখের। এটাই এখানকার নিত্যদিনের দৃশ্য। আর এই দৃশ্য হতাশার, এই দৃশ্য কষ্টের, এই দৃশ্য চরম ভোগান্তির!


বলছি, বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) কথা।


রাজধানীর নীলক্ষেত-পলাশীর মাঝামাঝিতে অবস্থিত এই ব্যানবেইস ভবনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরের অবসর–সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয় রয়েছে। ফলে এখানে প্রতিদিনই দেশের ৬৪টি জেলা থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা নিজেদের অবসর ভাতার জন্য ভিড় করছেন। এক্ষেত্রে তাদের অনেকের এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার উপক্রমও হয়, তবুও মিলছে না নিজেদের কাঙ্ক্ষিত অবসরের টাকা।



সম্প্রতি বেশ কয়েকদিন সরেজমিনে ব্যানবেইজ কার্যালয়ের নিচতলায় গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তাদের নানা ভোগান্তির বিষয়ে জানা যায়। জাতির মেরুদণ্ড গড়ার এই কারিগররা জীবনসায়াহ্নে এসে এখানে যে কী রকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তা কেবল এখানে আগতরা বুঝতে পারবেন।



অনলাইন কেন্দ্রিক শিক্ষকদের অবসরের এই টাকা দেওয়ার সিস্টেম চালু থাকলেও অনেক শিক্ষকের আবেদনে নানা সমস্যা থাকে বলে বোর্ড থেকে জানানো হয়। ফলে তাদের অনেককেই ঢাকায় আসতে হয়। আর এখানে এসে তারা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।


শিক্ষকরা বলছেন, তাদের মধ্যে যাদের কাগজপত্রে একটু খুঁত পায় তাদেরকে এখানে আসলে বলা হচ্ছে এটা নাই, সেটা নাই, কাগজপত্র অস্পষ্টসহ আরও কত কী! তবে এক্ষেত্রে এখানের কিছু কর্মচারী রয়েছে, যাদের কিছু টাকা দিয়ে অনেকে এই ভোগান্তি থেকে পার পাচ্ছেন। আর যারা এই পথে হাঁটছেন না, তাদের কাজ হতে দেরি হচ্ছে।


সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় প্রবেশ করে হাতের বাম দিকে মোড় নিলে কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয় আর প্রবেশ গেইট থেকে একটু সামনে গেলে উপরে উঠার যে সিঁড়ি রয়েছে, তার পাশ ঘেঁষে রয়েছে অবসর বোর্ডের কার্যালয়। দুই পাশে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা যার যেদিকে প্রয়োজন, সেদিকে লাইনের আওতায় জড়ো হচ্ছেন। এরপর নিজের ইনডেক্স নাম্বারসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিজের অবসরের টাকার খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে তথ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য পেয়ে তাদের অধিকাংশকে আবার বিষন্ন হতে দেখা যায়। এর কারণ অবসর ভাতা পেতে বিলম্বতা কিংবা কর্তৃপক্ষের আশ্বাস তাদের মনঃপুত না হওয়া।


সরেজমিনে আরও দেখা যায়, অবসর বোর্ডের কার্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে শিক্ষকদের সহায়তামূলক নানা ধরণের তথ্যও সংযুক্ত করা হয়েছে। কোথাও অবসর ভাতার জন্য আবেদনের ওয়েবসাইটের নাম, আবার কোথাও তথ্যকেন্দ্রের নাম্বার সংযুক্ত করা হয়েছে। একদিকে এটাও লেখা হয়েছ যে, "অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীগণ মধ্যস্বত্বভোগী দালাল থেকে দূরে থাকুন। তথ্য জানার সকল সুবিধা আপনার হাতের মুঠোয় মুঠোফোনের “অবসর” অ্যাপসে"। এই লেখা দেখে যে কেউ বুঝবে, এখানে যে দালাল রয়েছে, সেই বিষয়ে হয়তো কর্তৃপক্ষও অবগত আছে। তবে শিক্ষকরা বলছেন, নানা সহায়তার বাণী আওড়ালেও এখানে ভোগান্তির শেষ নেই। এ যেন বাণীতে সীমাবদ্ধ কথন। শুধু তাই নয়, হেল্প নাম্বার চালু থাকলেও তাদের ফোনে পাওয়া এ যেন রাজ্য জয় করা। সামান্য একটা তথ্যের জন্য শিক্ষকদের দূরদুরান্ত থেকে এসে ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে।



১৫ মার্চ, বুধবার অবসরে যাওয়া শিক্ষক জসীম উদ্দিন পটুয়াখালী থেকে এসেছেন ব্যানবেইসে। বয়সের বাড়ে এই শিক্ষকের হাঁটতেও সমস্যা হচ্ছে। অবসর বোর্ডের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন পার করে ৬০ বছরে অবসরে গেলাম। ভেবেছিলাম অবসরের টাকাটা পেলে নিজের ছোট ছেলেকে ব্যবসায়ের পুঁজি দেবো। কিন্তু ২০২০ সালে আবেদন করেও এখনো টাকা পেলাম না। একবার বলা হলো- তথ্যে ভুল আছে। আবার বলা হলো, কাগজপত্রের ঘাটতি আছে। এভাবে কয়েকবার এসে নানা কাগজপত্রও দিলাম। এরপরেও কাজ হচ্ছে না দেখে পরিচিত একজনকে দিয়ে এখান থেকে খবর নিতাম।  কিন্তু এভাবে আর কত? শেষ পর্যন্ত কষ্ট হলেও নিজে আসলাম খবর নিতে। আমাকে বলা হলো-আগামী জুনের দিকে পেতে পারি।


তিনি বলেন, জানি না, তাদের কথা মতো ঐ সময়ে টাকাটা পাবো কি-না? আর না পেলে এভাবে আসতে হবে আর ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। এই আর কী!


একইদিন সাতক্ষীরা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে (ব্যানবেইস) এসেছেন মো. আলী। তার সাথে তার মেয়ে এবং নাতীও ছিলেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমার জামাই ১৮ বছর ২ মাস চাকরি করার পর মারা যান। এরপর জামাইয়ের পেনসনের টাকা পেতে ২০২০ সালের নভেম্বরে আবেদন করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকাটা পাইনি। এইবারসহ মোট ৫ বার এখানে এসেছি। কিন্তু একেকবার একেকরকম কথা বলা হয়। তাই এবার নাতি ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, আজকে সচিবের সাথে দেখা করে আমার অসহায় মেয়েটার কথাগুলো বলবো। কিন্তু আজকে আবার বলা হলো সচিব নাকি নেই! এতোদূর থেকে আসলাম আবার ফিরে যেতে হবে।


ক্ষোভ প্রকাশ করে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আইয়ুব আলী বিবার্তাকে বলেন, অবসরে যাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করেছেন সাড়ে ৩ বছর আগে। এদিকে অনলাইনে বলা হচ্ছে আর কাগজপত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এরপরেও আপডেট না হওয়ায় ব্যানবেইসে আসলে বলা হলো আরও কাগজপত্র লাগবে। ফলে আবার কাগজপত্র জমা দিলাম। এখন বলা হলো- খুব তাড়াতাড়ি আপডেট হয়ে যাবে। জানি না- কবে আপডেট হবে এবং প্রক্রিয়া শেষ হয়ে আমি টাকাটা পাবো।


তিনি বলেন, আমার মেয়েকে এইবার প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করাবো। আর এর জন্য আমার পেনশনের টাকাটা খুব দরকার ছিল। কিন্তু যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকার আগ পর্যন্ত কবে পাবে এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। এখানে এসে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ভোগান্তির শিকার হোন, এটা আগেও শুনেছিলাম, এখন আমি নিজে সেই পথের যাত্রী হয়ে গেলাম।


রহমত উল্লাহ নামের চট্টগ্রাম জেলার একজন বিবার্তাকে বলেন, তার বাবা মারা গেছে ২০১৮ সালে। এরপর ২০২০ সালে তারা আবেদন করেছেন। কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা তারা পেয়েছেন কিন্তু অবসরেরটার খবর নাই। এজন্য এসেছেন খোঁজ নিতে। তাকে বলা হয়েছে তিনমাস পর পেতে পারেন।


তিনি বলেন, নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। ফলে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি।  অবসরের পরে শিক্ষকদের এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরা কোনভাবেই শোভা পায় না বলেও জানান তিনি। 


বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনির হোসেন তার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মা নাজমা বেগমের পেনসনের টাকার খোঁজ নিতে এসেছেন।  তিনি বিবার্তাকে বলেন, ২০১৯ সালে আমার মা অবসরে গেলে পেনসনের টাকার জন্য সেই বছরই আবেদন করি। কিন্তু এখন ২০২৩ সাল হয়ে গেলেও টাকা পাওয়ার খবর নেই। এজন্য আজকে ১৬ মার্চ এসেছি খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু আমাকে তথ্যকেন্দ্র থেকে বলা হলো আমার মায়ের কাগজপত্র সব ওকে করে ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এখন হয়তো ব্যাংক থেকে পাঠাচ্ছে না। ফান্ডিং এর অভাবে এটা পাঠানো হচ্ছে না বলে জানানো  হয়েছে।


ক্ষোভ প্রকাশ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, এই তথ্যটা জানতে সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে আমাকে আসতে হয়েছে। এরআগেও তিনবার এসেছি। অথচ কর্তৃপক্ষের হটলাইন চালু থাকলেও সেখানে টানা কয়েকদিন ফোন দিলেও কোন সাড়া পায়নি। আমার প্রশ্ন- ফোন না ধরলে এই সেবা চালু রেখে লাভ কী? ছোট একটা তথ্যের জন্য মানুষের কত ভোগান্তি, এখানে যারা আসে কেবল তারাই এটা বুঝতে পারে।


হটলাইনের ফোন রিসিভ না হওয়াসহ শিক্ষকদের ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বিবার্তাকে বলেন,এই রকম কোন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ বলে নাই। এটা হতে পারে আমাদের অনেক অডিট আপত্তি থাকে, অনেকে কথা বলতে চায়, সেক্ষেত্রে হয়তো নাম্বার ফ্রি হতে পারে না। তবে এতোটুকু বলতে পারি আমাদের কাছে এই রকম কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত পড়ে নাই।


অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের টাকা পেতে দেরী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়টা তো অল্প কথায় বলতে পারবো না। টাকার অভাবে আমাদের ২৪ হাজার আবেদন পেন্ডিং আছে। এই আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে দুই হাজার কোটি টাকা লাগবে। এই টাকার জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি। আমরা প্রতিমাসে টাকা পায় ৪২ কোটি টাকা। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার লাগে আরও ১০ কোটি বেশি। যার জন্য প্রতিমাসে ঘাটতিটা থেকে যায়। এভাবে ঘাটতিটা অনেক বেড়ে যায়। কাজেই এখানে যদি আর্থিক সংকট সমাধান না করা হয়, তাহলে এই সংকট সহজে সমাধান হবে না।



সার্বিক বিষয়ে জানতে অবসর সুবিধা বোর্ডের চেয়ারম্যান সোলেমান খানকে বিবার্তার পক্ষ থেকে কল দেয়া হলে তিনি বলেন, আমি জরুরি মিটিংয়ে আছি। কথা বলতে পারবো না।



উল্লেখ্য,২০০২ সালের ২৭ নং আইনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড গঠন হয়। আর ১৯৯০ সালে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর এর অধীন এমপিওভূক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদান কার্যক্রম এই দুই বোর্ডের আওতাভূক্ত। এমপিওভূক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে ৬ শতাংশ টাকা সঞ্চয় করে অবসর সুবিধাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া ৪ শতাংশ সঞ্চয় করে কল্যাণ ট্রাস্ট সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com