‘বইমেলায় স্টল ভাড়া বেশি, প্রকাশকরা বললেন, টিকব কিভাবে?’
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:০৫
‘বইমেলায় স্টল ভাড়া বেশি, প্রকাশকরা বললেন, টিকব কিভাবে?’
হাবিবুর রহমান রোমেল ও মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

কাগজসহ প্রকাশনার কাজে দরকারি সবকিছুর দাম বেড়ে গেলে তখন তো বইয়ের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এই পরিস্থিতিতে বইয়ের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে অনেক পাঠক বই কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। কারণ, আমাদের অধিকাংশ পাঠক মধ্যবিত্ত শ্রেণির। কিন্তু বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। বৈশ্বিক সংকটে কাগজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। কিন্তু আমরা তো ইচ্ছে করলে বইয়ের দাম দ্বিগুণ রাখতে পারছি না। কারণ পাঠকের চাহিদার কথা আমাদের মাথায় রাখতেই হয়। আমরা চাচ্ছি বইয়ের দাম একটা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। কিন্তু এভাবে তো প্রতিবছর কন্টিনিউ করা সম্ভব না। কাজেই এগুলোকে সমন্বয় করতে হলে স্টলের ভাড়া, কাগজের মূল্য কমানোসহ কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্য আমাদের দাবি তো অবশ্যই আছে। আর এগুলো আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি।


কথাগুলো বলেছেন অন্বেষা’র প্রকাশক মো. শাহাদাত হোসেন। অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ ঘিরে বাংলা একাডেমির স্টল ভাড়া এবং প্রকাশনা শিল্পের সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বিবার্তাকে এসব কথা বলেন।


তিনি বলেন, গতবছরও আমরা স্টলের ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়েছিলাম। তখন অর্ধেক ভাড়া রাখা হবে বলা হলেও পরে কিন্তু পুরো ভাড়াই নিয়েছে। এবার বৈশ্বিক সংকটে কাগজের ঊর্ধ্বমূল্যসহ নানা জটিল পরিস্থিতির জন্য আমরা ভেবেছিলাম, বাংলা একাডেমি ভাড়া কম রাখবে। কিন্তু এবারও ভাড়া কম না রেখে আগের মতোই রেখেছে।


এই প্রকাশক বলেন, আরেকটা বিষয় দেখেন বইমেলায় বাংলা একাডেমি আমাদের শুধু মাঠটা দেয়, বাকী সবকিছু প্রকাশকদের করতে হয়। কাজেই এখানে আমাদের ব্যয় অনেক হয়। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি যদি ভাড়াটা কিছুটা কমিয়ে দিতো, তাহলে আমরা প্রকাশকরা উপকৃত হতাম। আমরা পাঠকদের ভালো বই উপহার দিতে চাই। কিন্তু এর জন্য তো আমাদের সকলের সহযোগিতা লাগবে। অন্যথায়, আমরা টিকব কিভাবে?


‘জাগৃতি প্রকাশনী’র প্রকাশক ডা. রাজিয়া রহমান জলি বিবার্তাকে বলেন, বাংলা একাডেমির নির্ধারিত এই ভাড়া দিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। একদিকে কাগজসহ প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট সব জিনিসের দাম বৃদ্ধির সাথে ভাড়াও এই রকম থাকা অনেক চাপ হয়ে যায় প্রকাশকদের জন্য। যেহেতু বাংলা একাডেমি মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে, সেহেতু সরকারিভাবে কিছু ভর্তুকি দিয়ে ভাড়া কমালে প্রকাশকদের জন্য মঙ্গলজনক হতো।


মিজান পাবলিশার্স এর প্রকাশক মিজান বিবার্তাকে বলেন, এমনিতে আমরা এবার বিভিন্ন দিক থেকে নানা সংকটে হিমহিশ খাচ্ছি। সেই দিক থেকে স্টল ভাড়া একটু কমালে তো অবশ্যই ভালো হতো।


বিবার্তার অনুসন্ধানে দেখা যায়, এবার বাংলা একাডেমি (এক) ইউনিট (৮′ × ৮′ × ৮′ সাইজ) এর জন্য ভাড়া ১৫,১৮০ টাকা, ২ (দুই) ইউনিট (১৬′ × ৮ ′ × ৮´ সাইজ) এর জন্য ৩১,৬২৫ টাকা, ৩ (তিন) ইউনিট (২৪′ x ৮′ × ৮′ সাইজ) এর জন্য ৫৯,৮০০ টাকা, ৪ (চার) ইউনিট (৩২′ × ৮′ × ৮′ সাইজ) এর জন্য ৮৩,৪৯০ টাকা, প্যাভিলিয়ন (২০´ x ২০′ x ৮´ সাইজ) এর জন্য ১,৫১,৮০০ টাকা, প্যাভিলিয়ন (২৪´ × ২৪′ × ৮´ সাইজ) এর জন্য ১,৮৬,৩০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।


একাডেমির নির্ধারিত এই ভাড়া নিয়ে প্রকাশকদের আপত্তি থাকলেও অনেকটা নিরুপায় হয়ে তা পরিশোধ করে এখন স্টল সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।


সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশ এবার বেশ খোলামেলা। এই স্থানসহ বাংলা একাডেমি অংশেও এখন চলছে স্টল তৈরি ও সাজ-সজ্জার কাজ। এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। কেউ পার্টিশন আনছেন, কেউ তা বসাচ্ছেন। আবার কেউ পেরেক মারছেন। এভাবে বাঁশ, কাঠ ও হাতুড়ির খুটখাট শব্দে মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ।


মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্টল সাজাতে ব্যস্ত ছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর ম্যানেজার আকিব। তিনি বিবার্তাকে বলেন, স্টল বানাতে দেড় লাখ টাকার মালামাল নিজেরা কিনে দিয়েছি। ডিজাইনারকে দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। মিস্ত্রী খরচ লাগবে ২২ হাজারের উপরে লাগবে। তারপর রঙ, ইলেকট্রিক খরচ তো আছেই। ভাড়া বাবদ বাংলা একাডেমিকে দিতে হয়েছে ৫৯,৮০০ টাকা। সবমিলিয়ে অনেক খরচ।


মেলায় ভাড়া যে বেশি, সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাবাজারে জাগৃতির ১০০ স্কয়ার ফিটের দোকানে ভাড়া দেই ৮ হাজার টাকা। কাঁটাবনে কর্নকর্ড এম্পোরিয়ামে আমরা ওই একই ভাড়া দেই। অথচ বাংলা একাডেমি ৩ ইউনিট।


মানে ১৯২ স্কেয়ার ফিটের সেডের ভাড়া নিচ্ছে ৫৯ হাজার ৮০০ টাকা! ভাবা যায়?


২০ বছর ধরে অমর একুশে বইমেলায় কাজ করেন কাঠমিস্ত্রী ওয়াহিদ। মেলায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, এবার বাণিজ্য মেলায় বেশি কাজ করায় বইমেলায় বেশি কাজ করব না। ৬/৭ স্টলে কাজ করব।



স্টলে কাজের পারিশ্রমিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালামালসহ একটা সিঙ্গেল ইউনিটের স্টল বানাতে ৬ রোজ লাগে। আর বড় হলে সময় বেশি লাগে। সিঙ্গেল ইউনিটে ৩০ হাজার, ডাবল ইউনিটে ৫০/৬০ হাজার, ৩টা হলে ৭৫/৮০ হাজার; আর ডিজাইন বেশি হলে ৮০ হাজারের উপরে নেই।


মালপত্র ও মিস্ত্রীর রোজ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে এই শ্রমিক বলেন, দেখেন- যেই কাঠ আগে ৩০০ কেবি ছিল, এখন তা হইছে ৩৭০/৮০ টেকা, ৬০০ টেকার বোর্ড হইছে ৬৫০ টেকা। তারকাটা আগে ১২০ ছিল কিন্তু এইবার হইছে ১৪০/৫০ টেকা। এদিকে মিস্ত্রীর রোজও বাড়ছে। গেছেবার রোজ আছিল ৮০০ টেকা, এইবার ১০০০/ ১২০০ টেকার নিচে মিস্ত্রীই নাই।



সময় প্রকাশনের সেলসম্যান আরিফ বিবার্তাকে বলেন, এই প্যাভিলিয়নটি ২৪ ফুট বাই ২৪ ফুট। আমরা নিজেরাই মালামাল কিনছি। পুরাতন কিছু মালামাল ছিল। তবুও পুরা স্টল বানাইতে ৫ লাখ টাকার কম লাগব না। ১৬ জন মিস্ত্রী খাটতাছে এই স্টল বানাইতে।


অন্বেষার স্টলে দেখা যায়, ওয়ার্কশপ সম্পর্কিত কাজ করছেন একদল শ্রমিক। কথা হয় টিটু নামের লোহার মিস্ত্রীর সাথে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, তারা দেড় লাখ টাকা চুক্তিতে এই কাজ নিয়েছেন। এই স্টল রেডি করতে টোটাল ৩ লাখ টাকা খরচ হতে পারে বলে জানান ওই শ্রমিক।


মিজান পাবলিশার্স এ কাজ করছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। এর মধ্যে নাসির নামের একজন বিবার্তাকে বলেন, তিনি রঙের কাজ করছেন। তার দৈনিক মজুরি একহাজার টাকা। এখানে কর্মরত আরিফ নামের আরেকজন শ্রমিক বিবার্তাকে বলেন, এই স্টলে কর্কশিট ও রঙের কাজ করছেন ৫ জন। অন্যান্য সেক্টরে আরো অনেকে কাজ করছেন। তাদের দৈনিক মজুরি গড়ে ৬০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত।



স্টল ভাড়া বেশির বিষয়ে প্রকাশকদের অভিযোগ অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিবার্তাকে বলেন, এ বিষয়ে পরে কথা বলেন।


উল্লেখ্য,বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছরই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে বাঙালির এ প্রাণের উৎসব শুরু হলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর দিন-তারিখ এবং নির্ধারিত সময়ের ব্যতয় ঘটেছে। তবে এবার পহেলা ফেব্রুয়ারিতে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। ওই দিন সশরীরে উপস্থিত হয়ে অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


বিবার্তা/রাসেল-রোমেল/জেএইচ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com