
আমন ধানের ভরা মৌসুম চলছে এখন। সরকার এবং চালকল মালিকরা গেলো নভেম্বর মাস থেকে কিনতে শুরু করেছেন নতুন ধান। কিন্তু চালের মৌসুম, পর্যাপ্ত মজুত ও আমদানি পরও বাজারে সরবরাহ কম দেখিয়ে বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম।
ভরা মৌসুমেও চালের দাম না কমার কারণ হিসেবে পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা দোষারোপ করছেন একে অন্যকে। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। মূল্য বৃদ্ধির পেছনে মিল মালিকরা অনেকাংশে দায়ী। মিল, চাতাল মালিকরা চাল মজুত করে মূল্য বৃদ্ধির এ কারসাজি করছেন। এছাড়া বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি তাদের।
অন্যদিকে মিল মালিকদের মতে, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চালের বাজারে প্রবেশ, বড় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং মজুতদারদের অসম প্রতিযোগিতা চালের দাম বাড়াচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীদের কাছে লাখ লাখ টন চাল মজুত আছে। এসব চাল বের করে আনতে পারলে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে বলে মনে করেন তারা।
বাজার সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের কাজ পুরোদমে চললেও এখন পর্যন্ত নতুন চাল রাজধানীর বাজারগুলোতে পৌঁছায়নি। নতুন চাল বাজারে ওঠার আগেই দাম বাড়িয়ে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ নতুন চাল বাজারে আসার সাথে সাথেই নেমে যেতে পারে চালের দর। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গেলো দুই সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি চাল ২ থেকে ৩ টাকা করে বেড়েছে। আর এতে করে ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। নিয়মিত বাড়তির দিকে আছে মাঝারি ও সরু চালের দাম।
রাজধানীর কাওরানবাজারসহ অন্যান্য বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকা কেজি দরে। এছাড়া জিরাশাইল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা, নাজিরশাইল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা, আঠাশ ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, গুটি-স্বর্ণা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, কাটারিভোগ ৮৫ টাকা, বাসমতী ৬৪ টাকা এবং চিনিগুড়া চাল ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে এসব চাল কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে, গত মাসের তুলনায় চলতি সপ্তাহে প্রতি কেজি সরু চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং এই সপ্তাহে মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বর্তমানে বাজারে সরু চাল ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা এবং মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সপ্তাহান্তে চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়ছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের যোগসাজশে চালের দাম লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার বাসিন্দা শরীফুল ইসলামের। কাওরান বাজার কিচেনব মার্কেটে চাল কিনতে আসা শরীফুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, গত মাসে ৫০ কেজির আঠাশ চাল ২৪০০ টাকায় নিয়েছি। এখন ২৫০০ টাকায় নিতে হচ্ছে। এক মাসের কম সময়ে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। খুচরা কিনতে গেলে ৫২ টাকার নিচে নেয়া যায় না। আমার বেতন তো বছরে একবার বাড়ে। এভাবে প্রতি মাসে চালের দাম বাড়লে ঢাকায় কিভাবে চলবো বলেন? এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এসময় বিক্রেতাকে চালের মৌসুমে দাম কেন বেশি রাখছেন? এমন প্রশ্ন করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিবার্তাকে বলেন, এখন তো চালের মৌসুম। হিসাবে দাম তো কমার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে জিনিসের দাম বাড়লে আর কমে না। মিল মালিকরা চাল মজুত করে রাখছে। সিন্ডিকেটের কারণে এসব হচ্ছে। নাম কেন প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের ক্ষমতা আছে তারা কথা বলে, আমরা তো ক্ষমতাশালী না। ব্যবসা করে খাই। পত্রিকায় নাম দিলে সমস্যা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ১৯ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৬ লাখ মেট্রিক টন এবং ধান ০ দশমিক ৩৮ লাখ মেট্রিক টন। গেলো নভেম্বর মাস থেকে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রম চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ০৩৪ মেট্রিক টন চাল সংগৃহীত হয়েছে। এরই মধ্যে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪২ হাজার ১৫৪ টন আমন ধান ও ৪ লাখ ৪৫ হাজার ০১৯ মেট্রিক টন সিদ্ধ আমন চাল। গেলো ১১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৮ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে।
এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৭ লাখ টন। তার আগের অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিলো তিন কোটি ৬৬ লাখ টন। গত বছর বিপুল পরিমাণ চাল আমদানিও করা হয়েছে। এ অবস্থায় দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও চালের দাম কেন বাড়ছে এমন প্রশ্ন রইছ রাইছ এজেন্সির স্বত্বধিকারী মাইন উদ্দিনেরও। তিনি বিবার্তাকে বলেন, প্রতিদিনই চালের দাম বাড়ছে। চৈত্র মাসে প্রতিদিনই বাড়ে। এটা বন্ধ করার কোনো কৌশল নাই। আপনি বাজার খুঁজে দেখেন, কোনো দোকানে নতুন চাল নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা সুবিধা মতো যা ভোগ করা দরকার তাই করছে। এটা তো সিন্ডিকেটের কাজ।
তিনি বলেন, ধান-চালের কোনো অভাব নেই। নতুন এবং পুরাতন দুই মৌসুমের পর্যাপ্ত মজুতও আছে। টাকা দিলে ধান-চাল পাওয়া যায়। না পাইলে বুঝতাম বাজারে সংকট আছে। দাম বাড়ার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। বাজারে আইনি কোনো তৎপরতা নাই। মিল, চাতালে তল্লাশিও করা হয় না।
কাওরান বাজার ইসলামিয়া শান্তি সমিতি কিচেন মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রিয় রাইছ এজেন্সি স্বত্বাধিকার মো. লোকমান হোসেন বিবার্তাকে বলেন, বাজারে গত বৈশাখের যেসব চাল আছে, সেগুলোর দাম একটু উর্দ্ধ গতি। এখন স্বর্ণা ও ৪৯ এগুলোর দাম স্বাভাবিক আছে। মৌসুমের নতুন চাল বাজারে আসলে দাম কমে যেতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বিবার্তাকে বলেন, ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ টন চাল মজুত করে রেখেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে আগের চাল মজুত আছে। তখন ৯০০ টাকা মণ ধাণের দাম ছিলো। এখন না হয় ১৪০০ টাকা দরে ধান কিনতে হচ্ছে। সেই চাল কেন ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছে?
মিল মালিকরা চাল মজুত করে রেখেছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, যাদের কাছে ব্যাংকের টাকা আছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার একমাত্র কারণ তারা চাল মজুত করে ফেলেছে। পাইকারি বাজারেও প্রচুর পরিমাণে চাল মজুত আছে। তাদের কাছ থেকে যদি ধান-চাল গুলো বের করা যায়। তাহলে চালের দাম কমে যাবে। এসব চাল বের করতে পারলে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বাজারে চাল পাওয়া যাবে।
এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, মিলার গোষ্ঠীর মধ্যে ২০-৩০ জন আছে যাদের কাছে শত শত কোটি টাকা আছে। তারা ৯০০ টাকা দামের ধান কিনে মজুত করে রেখেছে। তারা এখন ১৪০০ টাকার ধানের দামে সাথে মিলিয়ে ব্যবসা করছে। তারা বাম্পার ব্যবসা করছে। আর যারা মাঝারি, ছোট রাইস মিল, হাস্কিং আছে তাদের কাছে তো টাকা নেই। তারা কি ব্যবসা করবে। এসব দেখবে কে? খাদ্য, অর্থ, কৃষি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তারা এসব দেখার কথা। কিন্তু তারা তো এসব দেখে না।
বিবার্তা/সোহেল/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]