তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪, ১০:৪৫
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলা সাহিত্যের ভুবনজয়ী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির জীবনে অফুরন্ত সৃজনশীলতার উৎস তিনি। জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙালির সব আবেগকে ধারণ করে। তাই তো তিনি একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার,চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। আবার তিনি বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির রাজনীতিতেও আবির্ভূত হয়েছিলেন।


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। যুগে যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ গভীর অনুশীলন ও ক্রমাগত নিরীক্ষার ধ্যমে তার সবকিছুই আত্মস্থ করেছিলেন।


তার সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে এবং সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বিষয়ের পরিবর্তন ও পালাবদল দেখা যায়। তার রচিত অসংখ্য গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র ও দেশবিদেশের বক্তৃতায় তার প্রতিফলন দেখা যায়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার এক ধনাঢ্য সংস্কৃতিমান ব্রাহ্মণ পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি ‘অভিলাষ’কবিতা রচনা করেন-


‘জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়।


’কবিতাটি ১৮৭৪ সালেতত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৭৮ সালে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান । কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালে শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে।


১৮৮৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। সে বছরই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ' কবিকাহিনী' প্রকাশ হয়। তিনি মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা ও ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি, বলাকা, পলাতকা, পূরবী, মহুয়া এরপর পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তার কবিতায় কখনো মানবহৃদয়ের বিষণ্ন তা, মানবপ্রেম বা প্রেম কিংবা রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চিন্তা, নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।


কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটির জন্য ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তার লেখা ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও এক হাজার ৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত আছে। তার প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলি নামে প্রকাশিত হয়েছে। যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি গ্রন্থে প্রকাশিত। তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।


তাঁর রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ বারবার নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু সব সংকট থেকে উত্তরণের এক মহাশক্তি ছিল তার মধ্যে । তিনি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন।


রবীন্দ্রনাথের গান তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গান দুটি যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালে বিলেত থেকে ফেরার পর বাবার আদেশে জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় জমিদারি তদারকি উপলক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান শাহজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম ও শিলাইদহ ঘুরে বেড়ান। এই সূত্রেই শিলাইদহে গড়ে ওঠে একটি কবিতীর্থ। তিনি ছিলেন স্বদেশীকতার বরেণ্য পুরুষ। রবীন্দ্রনাথ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি তার মনোভাব প্রকাশ করে গান রচনা করেন-


‘বাংলার মাটি, বাংলার জল বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পুণ্য
হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’


৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের জালিয়ান ওয়ালাবাগে এক মহাসমাবেশে ব্রিটিশ পুলিশের আকস্মিক গুলিতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। ইংরেজদের এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।


সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে নতুন প্রথা গড়ার কারিগর ছিলেন তিনি। সামাজিক কুপ্রথা, জাতপাত ও সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণা করেছেন । দরিদ্র প্রজাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য তিনি শিক্ষা, চিকিৎসা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, ঋণের দায় থেকে কৃষকদের মুক্তিদান প্রভৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ মনোনিবেশ ছিল।


বিশ্বকবি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। ১৯২৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। রবীন্দ্রসাহিত্য সর্বকালের সীমা জয় করেছিল। বাঙালির এই মিত্রকে আমাদের দেশে খণ্ডিত করে দেখার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল পাকিস্তান শাসনামলে। খণ্ডিত নয় বরং বর্জন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল সে সময়ে। ১৯৬৭ সালের ২৮ জুন দৈনিক আজাদে প্রকাশিত ১৯ বুদ্ধিজীবীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, বীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের কাছে সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জনের অশুভ তৎপরতা টিকে থাকেনি চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির প্রবাহের কাছে। আজও সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমাগত তাঁকে নিয়ে মিথ্যা মনগড়া অপপ্রচার করে যাচ্ছে। যদিও সে সব অশুভ তৎপরতা কোনো ঠিকানা পায় না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আজ তার ১৬৩ তম জন্মজয়ন্তীতে এসেও নীরবে মানবজাতীর মাঝে আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন । কবির কথাতেই বলতে হয়-


তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com