
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সুগম হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রা। ২৬ জুন, রোববার থেকে গণপরিবহনে পদ্মা সেতু পাড়ি দেবে দুই পাড়ের মানুষ। সেতু পাড়ি দিতে এরইমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে দেড় হাজার যাত্রীবাহী বাস।
জেলায় জেলায় তৈরি হচ্ছে আরও নতুন বাস। বিভিন্ন স্টাইল আর রং-বেরঙয়ে সাজানো হচ্ছে এসব বাস। পদ্মা সেতু হয়ে চলাচল করতে যাওয়া বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিআরটিসি বাসের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের এই সংস্থাটি। এতদিন যেসব জেলায় বিআরটিসি বাস ছিল না, এমন জেলায়ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) ও নন-এসি দুই ধরনের বাস নামাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ২৬শে জুন দুই পাড়ের গণপরিবহন চলাচল করবে।
পদ্মা সেতু দিয়ে ৬০টি পরিবহন কোম্পানি প্রায় দেড় হাজার বাস সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করবে। শরীয়তপুরে শতাধিক বাস প্রস্তুত করা হয়েছে। ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার বাস মালিকরা নতুন বাস নামাচ্ছেন। প্রস্তুতি নিতে পিছিয়ে নেই সারা দেশে চলাচলকারী পরিবহন গ্রুপগুলোও।
পরিবহন কোম্পাানিগুলো সায়েদাবাদ যাত্রাবাড়ী এলাকায় কাউন্টার খুলে বসেছেন। অনেকেই নতুন করে জায়গা খুঁজছেন। আগে যেসব পরিবহন মালিক গাবতলী থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে বাস চালাতেন তারাও এখন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছেন।
গ্রিনলাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমরা ৩০টি বাস চালু করবো। এগুলো তিনটি রুটে চলবে। ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা রুটে ১০টি, ঢাকা-যশোর-বেনাপোল রুটে ১০টি, ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা রুটে ১০টি করে বাস চলবে। বন্যার কারণে অনলাইনে কিছুটা কম টিকিট বিক্রি হচ্ছে। তবে অফলাইনে যথেষ্ট টিকিট বিক্রি হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা বাসের সংখ্যা বাড়াবো। আমাদের কিছু বাস মালয়েশিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সেতু উদ্বোধনের আগেই হাজার হাজার বাস প্রস্তুত হয়েছে। সেতু চালু হলে আরও বাস বাড়বে। সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যুক্ত করবে নতুন পরিবহনগুলো। অনেকেই রুট পারমিট নিয়েছেন। কেউ কেউ রুট পারমিট নেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় তৈরি করা বাসগুলো যাত্রী পারাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। মানুষ চাইলেই দুই পাড়ে যখন তখন পাড়ি দিতে পারবে। তবে অনেকেই বলছেন, নতুন রুটে নতুন বাস নামলেও সরকারকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে। অনেক অসাধু পরিবহন ব্যবসায়ী পুরাতন বাস কিংবা ফিটনেস বিহীন বাসগুলো রং করে এই রুটে নামাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কসহ দক্ষিণের হাইওয়েগুলোর জন্য অনেক বাস উপযোগী নয়। তবুও এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা লাভের আসায় এসব বাস নামাচ্ছেন। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবহন মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় গাবতলী-পাটুরিয়া রুটের বাসগুলো সায়েদাবাদ কেন্দ্রিক হয়েছে। তবে এখানে যথেষ্ট জায়গা নেই।
সায়েদাবাদে কয়েকটি বড় কোম্পানির বাস ছাড়া ছোট ছোট কোম্পানির বাস সেখানে রাখার পরিবেশ নেই। নেই কাউন্টার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) সূত্র জানায়, আগের মতো ফেরি পথেও চলবে বিআরটিসি বাস। পদ্মা সেতু পারাপারে নতুন ৬০ থেকে ৭০টি বাস বিভিন্ন রুটে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী বাসের অনেক কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। বর্তমানে মাওয়া হয়ে ১৩টি পথে বেসরকারি কোম্পানির বাস চলাচলের অনুমতি আছে।
বিআরটিসির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ফেরি পারাপারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে খুলনা ও যশোরে ১৬ থেকে ১৭টি বাস চলাচল করে। বরিশাল থেকে মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি পর্যন্ত চলে ১৫টি বাস। তবে এগুলো ফেরি পার হয়ে ঢাকায় আসে না। পদ্মা সেতু চালুর পর এগুলো বরিশাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু পারাপারে বিআরটিসির বাস চালু হবে। পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলাতেই চলবে বাস। তবে কতগুলো বাস নামানো দরকার এবং কোন কোন পথে চলাচল করবে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ চলছে।
গ্রিন লাইন পরিবহন কয়েক বছর আগে বরিশালে বাসসেবা চালু করেছিল। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা রুটে পরীক্ষামূলকভাবে সাতটি বাস নামাতে চায় তারা।
নতুন রুটে বাস চালানোর বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে গ্রিন লাইন পরিবহনের ব্যবস্থাপক (কল্যাণপুর) আসাদুজ্জামান বলেন, ২৬ জুন থেকে সাতটি বিলাসবহুল বাস এই রুটে নামাতে চান তাঁরা। এর মধ্যে ডাবল ডেকার, স্লিপার, বিজনেস ও ইকোনমি ক্লাসের বাস থাকতে পারে। গ্রিন লাইন বর্তমানে মাওয়া ঘাট দিয়ে খুলনায় বাস সার্ভিস চালাচ্ছে।
তবে অন্যান্য পরিবহন কোম্পানি দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সামাদ বলেন, ঢাকা থেকে বরিশালগামী বেশির ভাগ যাত্রী লঞ্চে যাতায়াত করেন। তাই পদ্মা সেতু চালু হলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাত্রীদের চাহিদা বুঝে ধীরে ধীরে তাঁরা বাস নামাতে চান।
বহুল প্রতীক্ষিত ও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়কপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হলো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা আশা করছেন, এখন ওই অঞ্চল থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য গন্তব্যে আরামদায়ক ও বিলাসবহুল বাস চালু হবে। তবে পরিবহন কোম্পানিগুলো দেখেশুনে পদ্মা সেতু হয়ে এসব গন্তব্যে নতুন বাস নামাতে চায়।
এরই মধ্যে ১৯ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পদ্মা সেতু হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বাসের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কাছ থেকে নেওয়া দূরত্ব এবং বিদ্যমান ফেরি ও সেতুর টোলের হালনাগাদ তালিকা ধরে এ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুর হয়ে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। এ পথে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২১ টাকা। এ পথে পদ্মা সেতু ছাড়াও চারটি জায়গায় ৫৩০ টাকা টোল দিতে হয়। ঢাকা থেকে পিরোজপুরের (২০৬ কিলোমিটার) ভাড়া ৫৩২ টাকা। ঢাকা থেকে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার দূরত্ব ২৭৬ কিলোমিটার। এ পথে নতুন ভাড়া ৭০১ টাকা।
বিআরটিএর এই ভাড়ার তালিকা নন-এসি বা সাধারণ বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসি বাসের ভাড়া বাসমালিকেরা ঠিক করেন।
এছাড়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাসের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি। তারা পদ্মা সেতু হয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ও নন-এসি দুই ধরনের বাসই নামাবে। বিদ্যমান বাসের বাইরে নতুন ৬০–৭০টি বাস বিভিন্ন পথে চালুর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিআরটিসির পরিচালন (অপারেশন) বিভাগের তথ্য অনুসারে, বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোও পদ্মা সেতু চালুর পর নতুন বাস নামাতে চাইছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরের একটি নতুন কোম্পানি পাঁচটি রুটে বাস নামাতে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আবেদন করেছে। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে বৈঠক হয় কমিশনারের কার্যালয়ে। শরীয়তপুরের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ সূত্র। বিআরটিএ বাসের রুট দেওয়ার ক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে এবং ভাড়ার হার ঠিক করে দেয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী বাসের অনেক কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলতে হবে। এখন পর্যন্ত বিআরটিএতে এ বিষয়ে কোনো আবেদন আসেনি। বর্তমানে মাওয়া হয়ে ১৩টি রুটে বেসরকারি কোম্পানির বাস চলাচলের অনুমতি আছে।
এর বাইরে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশাল ও কুয়াকাটা রুটে নতুন করে গ্রিন লাইন ও শ্যামলী পরিবহন বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন থেকে বরিশাল রুটে বাস চালাতে চায় তারা।
শ্যামলী পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে উদ্বোধনের পরদিন থেকে এই রুটে বাস চালাতে চান তাঁরা। প্রাথমিকভাবে ৪০টি বাস পরিচালনার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। তিনি জানান, যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে ৩২ বা ৩৬ আসনের নন-এসি বাস চালাবেন তাঁরা। এতে ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় কিছুটা বেশি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো ৫০ থেকে ৬০ টাকা বাড়ানো হতে পারে।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]