১০ জানুয়ারি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাওয়ার দিন
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৮
১০ জানুয়ারি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাওয়ার দিন
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে দিনটি আর অন্য সব দিনের চেয়ে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদিন রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায় প্রথমবারের মতো পা রাখেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাংলার অবিসংবাদিত নেতার পদধূলিতে সেই স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি।


১৯৪৭-এ ভারত ভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার মাত্রা বেড়েই চলছিল। জাতি যখন দিকভ্রান্ত, ঠিক সেসময়ে পাকিস্তানিদের দুঃশাসন থেকে বাঙালি জাতিকে চিরতরে মুক্তি দিতে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতার আন্দোলনের পথ মসৃণ ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, করতে হয়েছে বারবার কারাবরণ। জীবনের সোনালি সময়ের ২৩টি বসন্ত বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তিতে আন্দোলন আর কারাগারকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি।


৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬ সালের ছয় দফার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সোপান রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে তর্জনী উঁচিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন, শোষণ বন্ধের হুশিয়ারি দেন বঙ্গবন্ধু। সেই সাথে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানান বঙ্গবন্ধু। বাঙালির স্বাধীনতা স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের কুখ্যাত মিয়ানওয়ালি কারাগারে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। যদিও এর আগে প্রথম প্রহরেই দূরদর্শী এ মহানায়ক দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।


নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যখন বাঙালিরা লিপ্ত, তখন জাতির পিতা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফাঁসির আসামি হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই জাতির পিতার ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের বিজয় অর্জিত হওয়ায় সেই অভিলাষ থেকে পিছু হটতে হয় ইয়াহিয়া খানকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর নেতার মুক্তি দাবিতে জেগে উঠেছিল বাঙালি, সোচ্চার হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতারা। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।


বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলীর কাছে বার্তা পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজস্থ হাবীব আলীর বাসভবনে নিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। এসময় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন স্বাধীন বাংলায় ফিরে তিনি তার সিদ্ধান্ত জানাবেন।


১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে পাকিস্তান থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ভিআইপি লাউঞ্জে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা স্বাগত জানান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছে।


দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবো। আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন স্বদেশে ফেরার জন্য ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে রওনা দেন তিনি। দেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে দিল্লীতে। সেখানেও তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়।ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এসময় বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন বাংলার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী বিমান।


বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতারা পুষ্পমাল্য হাতে ছুটে যান প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। মাল্যভূষিত হওয়ার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন বঙ্গবন্ধু। জাতির জনক স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এসময় বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হন লাখো জনতা।


এরপর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতাদের নিয়ে ট্রাকে করে রওয়ানা দেন বঙ্গবন্ধু। রাজপথের দুই পার্শ্বে দাঁড়ানো জনসমুদ্রের কারণে ৬ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতেই সময় লেগে যায় দুই ঘন্টারও বেশি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে লাখ লাখ রেসকোর্স ময়দানে অপেক্ষমাণ জনতার জনসমুদ্রে পৌঁছান রাজনীতির মহাকবি। লাখো জনতা সেখানে তাঁকে স্বাগত জানায়। এরপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।


হাজার বছরের সেরা বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘরে ফেরার দিনটিকে তাই আজো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে পুরো জাতি।


আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বিবার্তাকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দীর্ঘ নয় মাসের লড়াই-সংগ্রাম শেষে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ।


১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করেছিল এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে ভারতে পৌঁছেন। সেসময়ে ইন্ধিরা গান্ধীসহ ভারতের কেবিনেট সদস্যদের উপস্থিতিতে তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রমর্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয়। ১০ জানুয়ারি বিকেলে জাতির পিতা বাংলাদেশে পদার্পণ করেন। লাখ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে বরণ করতে বিমানবন্দর গিয়েছিলেন। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং অনেক বড় পাওয়া ছিল।


এদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বরাবরের মতো এবারও নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে বুধবার বেলা আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভার আয়োজন করেছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এমপি।


বিবার্তা/সোহেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com