'টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান' অর্থাৎ সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ঠিক তেমনিভাবে ২০২৩ সালও শেষের দিকে। মাঝখানে আর মাত্র একটি দিন, তারপর শুরু হতে যাচ্ছে নতুন বছর। নতুন বছরে নতুন করে আবার সবকিছু শুরু হতে যাচ্ছে। তবে ২০২৩ সালটা বাংলাদেশের জন্য ছিল অন্যরকম। বছর জুড়ে যেমন ছিল মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন তেমনি ছিল দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। চলুন দেখে আসা যাক বছর জুড়ে আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম।
২০২৩ সালটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। বছরজুড়ে নানা ঘটনা ঘটেছে, ভালো-মন্দ মিলিয়ে। ইতিবাচক ঘটনাগুলো আলোচিত হয়েছে, আবার নেতিবাচক ঘটনাগুলোও সমালোচিত হয়েছে। জাতীয় ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২৩ সাল ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলেছে। নির্বাচন ইস্যুতে অবরোধ-হরতালও হয়েছে। এর মধ্যেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণে রেকর্ড, মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ, জ্বালানি তেলের মূল্য, ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ইত্যাদি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি:
বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। এর ফলে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য এখন অধিকাংশ নিত্যপণ্যই কেনা সম্ভব নয়। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। এতে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগ ও অশান্তি নেমে এসেছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরম আকার ধারণ করেছে। বছরের শুরু থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বছরজুড়েই বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়া ছিল। ডিম, পেঁয়াজ, আলু, শাক-সবজি, মাছ-মাংসের দাম ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। এছাড়া তেল, ডাল, চিনি, আটা, ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ছিল অস্বস্তিকর। এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক অসুবিধা হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রায় চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।
ডিম, আলু ও পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা দরও বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা ছিল মুখে মুখে। বেঁধে দেওয়া দর কোনো পণ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন হয়নি। বিদায়ী বছর সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় কাঁচামরিচ। জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬৫০ টাকায় কেজি বিক্রি হয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে দাম আরও অস্বাভাবিক ছিল। দেশের কোনো কোনো জেলায় রেকর্ড ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে কাঁচামরিচের কেজি। শেষ পর্যন্ত সরকারের নীতি সহায়তায় আমদানি হতে শুরু করলে দাম কমতে থাকে।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেই এর বড় প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। এবারও প্রথম দফায় শুল্ক আরোপ এবং দ্বিতীয় দফায় রপ্তানি মূল্য বেঁধে দেওয়ায় নভেম্বরে দেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজি দেড়শ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে তৃতীয় দফায় ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে পেঁয়াজের বাজারে যেন আগুন লেগে যায়। এক রাতেই কেজিতে ১০০ টাকার বেশি দাম বেড়ে পেঁয়াজের দর ওঠে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা। তবে দেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করায় এবং তড়িঘড়ি ভারতের বিকল্প দেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ নেওয়ায় বেড়ে যাওয়া দাম থেকে এখন কমেছে। তার পরও দেশি-বিদেশি পেঁয়াজ এখনও ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। এখনও গত বছরের তুলনায় তিন গুণ দাম।
যদিও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি বহির্ভূত পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস, প্রত্যাশিত উচ্চতর কৃষি উৎপাদন ও নতুন কাঠামোর অধীনে মুদ্রানীতির কঠোরতার কারণে মূল্যস্ফীতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের নয় শতাংশ থেকে কমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, গত আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল নয় দশমিক ৯২ শতাংশ। একই মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এর আগে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল নয় দশমিক ৬৯ শতাংশ। ওই মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল নয় দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে দেশে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল সাত দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুলাইয়ে তা ছিল নয় দশমিক ৪৭ শতাংশ।
ডলার সংকট:
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যেসব সমস্যার মুখে পড়েছে, এর মূলে রয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। নীতিনির্ধারকরা মনে করেছিলেন, ডলারের সংকট এবং এর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সাময়িক। তারা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, অচিরেই এর সমাধান হবে। কিন্তু সেই ‘অচিরেই’ আর আসছে না। ডলার সংকট ও দর বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংক জানিয়েছে যে, অগাস্ট মাসে রেমিটেন্স কমেছে ২১ শতাংশ, যা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি বৈদেশিক মুদ্রার কমতে থাকা রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অগাস্টে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২০৩কোটি ৬৯ লাখ ডলার। প্রায় দুই বছর ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয় ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান সংকট বাড়িয়ে তুলেছে।
খেলাপি ঋণে রেকর্ড:
নানা ধরনের ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক; বরং দিন দিন তা বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ হিসাব বলছে, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থাৎ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।
ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর ১ বছরে (জুন-২২ থেকে জুন-২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি-সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
করোনা মহামারির সময় থেকে ঋণ পরিশোধে নানা ছাড় ও সুবিধা দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। এছাড়া ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা লোকজনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা বাড়ছে, যা কঠোরভাবে রোধ করা প্রয়োজন।
মার্কিন ভিসানীতির চ্যালেঞ্জ:
বিদায়ী বছরে কূটনৈতিক পাড়ায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মার্কিন ভিসানীতি। সেই ভিসানীতি মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই বছর সমাপ্তির পথে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি উচ্চপদস্থদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৪ মে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার লক্ষ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে এমন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অর্থ হলো; ভোট কারচুপি, ভোটারকে ভয়ভীতি দেখানো, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ, মিডিয়াকে মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া। এসব কর্মকাণ্ডের জন্যও ভিসানীতির প্রয়োগ হতে পারে।
জ্বালানি তেলের মূল্য:
চলতি বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দম কমেছে ১০ শতাংশ। দুই বছরের মধ্যে এবারই প্রথম নিম্নমুখী প্রবণতায় বছর শেষ করতে যাচ্ছে জ্বালানি তেলের বাজার। ভূরাজনৈতিক সংকট, উত্তোলন হ্রাস ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কঠোর নীতির কারণে বছরজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। এসব সংকট না থাকলে দাম আরো কমে যেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে প্রত্যাশিত নিম্ন সুদহার ও ডলারের বিনিময়মূল্য কম থাকলে বিক্রি বাড়তে পারে। বাজার প্রবণতা অনুযায়ী, ডলারের অবনমন ঘটলে ভিন্ন মুদ্রার গ্রাহকের জন্য জ্বালানি ক্রয় খরচ কমে আসে। এতে ডলারে লেনদেন হওয়া পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়।
রয়টার্সের এক সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৩০ অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকের প্রত্যাশা, আগামী বছর প্রতি ব্যারেল ব্রেন্টের গড় দাম হতে পারে ৮৪ ডলার ৪৩ সেন্ট। আর চলতি বছরের গড় দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের আশপাশে থাকতে পারে, যা ২০২২ সালের ব্যারেলপ্রতি গড়ে ১০০ ডলার দরের চেয়ে যথেষ্ট কম। গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক বেড়েছিল।
***এছাড়া ২০২৩ সালটি ছিল উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বেশ কিছু বড় প্রকল্পের উদ্বোধন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে। কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করবে। পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ, যা দেশের উত্তর-দক্ষিণ যোগাযোগকে আরও দ্রুত ও সহজতর করবে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল, যা ঢাকা শহরের যানজট কমাতে সাহায্য করবে। আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেললাইন, যা বাংলাদেশের সাথে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট, যা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ, যা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে। এই প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও, এগুলো জনগণের জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল:
নতুন এই টার্মিনালে থাকবে বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রীসেবা। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এই টার্মিনালের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন। তৃতীয় এই টার্মিনালের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজই শেষ। টার্মিনালের পুরো কার্যক্রম ২০২৪ সালের শেষ দিকে চালানো সম্ভব হবে।
টার্মিনালটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ। বাকি তহবিলের জোগানদাতা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। টার্মিনালটির নকশা করেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ও ব্যস্ততম হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের নকশাকার রোহানি বাহারিন।
দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনালে এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার যাত্রী সেবা পাচ্ছেন। সেই হিসাবে বিমানবন্দরটি বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়। বেবিচকের তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
বিশ্বমানের এই টার্মিনালে ১ হাজার ৪৪টি গাড়ি রাখার সক্ষমতাসহ বহুতল গাড়ি পার্কিং তৈরি করা হচ্ছে। এই টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে। এ ছাড়া তৃতীয় টার্মিনালে ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে এবং অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য চারটি পৃথক বেল্ট থাকবে। একটি করিডরের মাধ্যমে পুরোনো দুটি টার্মিনালের সঙ্গে নতুন টার্মিনালকে যুক্ত করা হবে।
কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল:
দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন যুগের সূচনা করেছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এ টানেলটি মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরিত করবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের দুই অঞ্চলকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর পর তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেল সড়ক পরিবহন খাতে দ্বিতীয় 'ড্রিম প্রজেক্ট'। চীনের সাংহাইয়ের মতো 'ওয়ান সিটি টু টাউন' মডেল অনুসরণ করে টানেলটি তৈরি করা হয়েছে। টানেলটি কর্ণফুলীর উত্তর প্রান্তে চট্টগ্রাম বন্দরনগরীকে নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ এর দুই পাশের দুই বড় অর্থনৈতিক করিডোরকে যুক্ত করে চট্টগ্রামকে বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে 'গেম চেঞ্জার' হিসেবে কাজ করবে। ভবিষ্যতে এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উন্নতি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগাযোগ জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ:
দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা বাংলাদেশের মর্যাদা ও গর্বের প্রতীক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার জন্যও পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্ব। বিশ্বব্যাংক এবং এর সঙ্গে আরও কয়েকটি দাতাগোষ্ঠী যখন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করেনি, ঠিক তখন সাহসী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেন। ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথপরিক্রমায় একটি বিশেষ দিন এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার একটি ব্যতিক্রমী মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধা দূর এবং একটি সমন্বিত ও একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত। অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় এখন পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে আনা হয়েছে। এ জন্য পদ্মা সেতুতে নির্মিত হয়েছে প্রথম ব্যালাস্টলেস রেলপথ। দোতলা পদ্মা সেতুর ওপরতলা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন এবং নিচতলা দিয়ে চলছে রেল। সেতুর উভয় প্রান্তেই ভায়াডাক্টে বসানো হয়েছে দেশের প্রথম ব্যালাস্টলেস বা পাথরবিহীন রেললাইন।
প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। সমাপ্ত হওয়ার পর রেল যোগাযোগ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী শহরের প্রবেশ পথ আরও বর্ধিত হবে, যা মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলার নতুন এলাকাকে যুক্ত করবে। প্রকল্পটি ঢাকা-যশোর-খুলনাকে ২১২ দশমিক শূন্য পাঁচ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রুট দিয়ে বিকল্প রেলপথ সংযোগ স্থাপন করবে।
আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল:
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে নানা উদ্যোগ নেয়। যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে প্রকল্পের বিবরণে জানা গেছে।
মেট্রো রেল প্রতি ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং প্রতিদিন ৫ লক্ষ যাত্রী বহন করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি চার মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন আসবে। প্রতিটি ট্রেন ২,৩০০ যাত্রী নিয়ে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। ৪১,২৩৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হবে ২০২৮ সালে।
আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেললাইন:
আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত রেলপথ যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১ নভেম্বর, ২০২৩ গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নয়াদিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন।
মোট ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেলপথের বাংলাদেশ অংশে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে দুদেশের বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এমনটাই আশা করছেন ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে এ লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে। অনুমতি মিলেছে ভুটানে উৎপাদিত সব পণ্য (সুতা ও আলু ব্যতীত) ও ভারত থেকে আমদানি করা হবে ৬০টি পণ্য। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের পণ্য উল্লিখিত রেলপথ দিয়ে রফতানি করা যাবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ১ম ইউনিট:
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরিকল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ ও রাশিয়া দুই দেশের সরকার প্রধানের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ৬ অক্টোবর, ২০২৩। রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম বুঝে পাওয়ার মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পারমাণবিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২%-এর অধিক বৃদ্ধি পাবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছতে অর্থাৎ দেশে ১০০% বিদ্যুতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এতে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের মনোপলি হতে মুক্তি ও দেশে দ্রুত শিল্পায়নে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি যোগ হওয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী বিরাট উল্লম্ফন ঘটবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১২,০০০-এর অধিক নির্মাণকর্মী, প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞের কর্মসংস্থান হবে। পরমাণুবিজ্ঞান বিষয়ে রাশান ফেডারেশনে প্রতি বছর ২০-৩০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের সুযোগ হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশবান্ধব হওয়ায় Climate Change Mitigation-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং গত ৩০ বছরে কোনো নতুন দেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে পারেনি। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ৩৩তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ:
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথের দূরত্ব দেড় শ’ কিলোমিটার। সড়কপথে বাসে যেতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। আর এ মহাসড়কে যানজটে পড়লে ছয়-সাত ঘণ্টাও লেগে যায়। এ রেলপথ চালু হলে ছয়-সাত ঘণ্টার এ দূরত্ব নেমে আসবে অর্ধেকে; কমবে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসার পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি হবে বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের।
দেশের পর্যটনের খাতকে অনেক এগিয়ে নেবে এ রেলপথ। আগে দূরত্ব, যানজট ও দুর্ঘটনার ভয়ে অনেকে কক্সবাজার যেতে চাইতেন না। ট্রেন চালু হলে এখন তারাও ঘুরে আসবেন কক্সবাজার থেকে। সকালে গিয়ে রাতে বা পরদিন ফিরে আসবেন অনেক পর্যটক। তাতে খরচও হবে কম।
পর্যটনের পাশাপাশি রেলের সুফল পাবে কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আরও কয়েকটি খাতে। সেসব খাতের মধ্যে রয়েছে- লবণ, কৃষিপণ্য, মৎস্য ও শুঁটকি। এসব পণ্য কম খরচে আনা-নেয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কৃষিপণ্য সহজে আনা-নেয়ার সুবিধা থাকলে কৃষকেরও দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও কিছুটা গতি আনতে পারে নতুন এ রেলপথ। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়বে পর্যটন, কৃষি ও চিংড়ি শিল্পে। ফলে গতি পাবে এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে:
যানজট কমিয়ে রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দিতে দুয়ার খুলতে যাচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের সড়ক পথের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হয়েছে বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে এর শেষ হবে। এরমধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
প্রতিদিন ঢাকার এক লাখ যানবাহন এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। রাজধানীর ভেতরে ৩১টি স্থান থেকে উড়ালপথে ওঠানামা করবে গাড়ি। পাঁচ থেকে ছয়তলা ভবনের সমান উঁচু হচ্ছে এ উড়াল সড়কপথ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে কাওলা থেকে শুরু হয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে এ সড়ক।
নগরীর যানজট নিরসনে জাদুর কাঠি হিসেবে কাজ করবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক) প্রকল্প। চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি ছুটবে নগরবাসীর স্বপ্নের এ প্রকল্পে। তবে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ২০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে যাত্রাবাড়ী।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প:
ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় জীবাশ্ম জ্বালানির দাম। তারপর বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয় বাংলাদেশে। এই অবস্থায়, আগামীতে দাম বাড়ার এই চাপ মোকাবিলায় এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির কারণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎখাতে বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে মোট ৭০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
চলতি বছরে ১,২০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন ও সই হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে, ডেনমার্কের ১৩০ কোটি ডলারের অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রস্তাব। অক্টোবরে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালানোর অনুমোদন দেয় সরকার। বিদ্যমান প্রকল্পের পাশাপাশি অনুমোদিত ও পর্যালোচনার অধীন থাকা এসব প্রকল্পে থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট সক্ষমতা হবে ২,৭০০ মেগাওয়াট। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ৯টি প্রকল্প থেকে ১,২৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ট্যারিফ অনুমোদন করেছে সরকার। জাপান, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব প্রকল্পের বিনিয়োগ আসছে।
সার্বজনিন পেনশন সেবা:
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হল সর্বজনীন পেনশন স্কিম। সে স্কিমের আওতায় সরকারি চাকুরিজীবী ব্যতীত দেশের সকল নাগরিক পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ কারো বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই এখন অনলাইনে এটিতে নিবন্ধন করতে পারবেন।
দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাঁদের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ।
এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করা হয়েছে।
পেনশন স্কিমের মাধ্যমে ১৮ বছর বয়সের বেশি দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা। আর এ কারণেই চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থ।
***বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। ২০২৩ সালের হিসাবে, বাংলাদেশের জিডিপি বিশ্বের ৩৯তম বৃহত্তম। তবে, ২০২২ সালের শেষের দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে, এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। এছাড়াও, ডলারের অভাবে অনেক আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে, যা শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি করছে।
বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে এবং আমদানি নিষিদ্ধ করছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার বিভিন্ন কর ছাড় দিচ্ছে।
এতসব সমস্যার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন গত কয়েক দশকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সরকারের ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে দেশজুড়ে নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু, ব্রিজ, বিমানবন্দর, রেলপথ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গ্যাস পাইপলাইন, এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মিত হয়েছে। এই অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে দেশের অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে।
বিবার্তা/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]