স্পর্শকাতর দুর্নীতি ধরতে দুদক এর স্ট্রাইকিং ফোর্স
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ১৬:১৫
স্পর্শকাতর দুর্নীতি ধরতে দুদক এর স্ট্রাইকিং ফোর্স
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগুরুত্বপূর্ণ, বহুল আলোচিত এবং স্পর্শকাতর দুর্নীতির ঘটনার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের লক্ষ্যে স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।


এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ ধরনের স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করেছিল দুদক। এরপর গোলাম রহমান কমিশনারের সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ধরতে টিম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ইকবাল মাহমুদ কমিশনারের সময়ে ১১টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়।


দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় দুদক। এর অংশ হিসাবে সংস্থাটির গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম গঠন করা হয়েছে।



ওই বিশেষ টিমের প্রধান করা হয়েছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক আব্দুল্লা আল জাহিদকে। এছাড়া মানি লন্ডারিং বিভাগের পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীকে সমন্বয়ক হিসাবে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদ (বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান) উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার মনি (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-৩), উপ-পরিচালক নাজমুল হোসাইন (মানি লন্ডারিং), উপ-পরিচালক মো. তানজির হাসিব সরকার, সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামূল আহসান গাজী (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা-২) এবং সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী (মানি লন্ডারিং)।



মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন কমিশন এই প্রথম স্ট্রাইকিং ফোর্স বা বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ধরতে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহন করল। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের অংশ হিসাবে ১৮ এপ্রিল কমিশনের সভায় এ বিষয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।


কমিশন সূত্র জানায়, ওই দিনের সভায় আলোচ্যসূচির মধ্যে স্পর্শকাতর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ টিম বা স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সভায় জানানো হয়, দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও বেগবান করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনার জন্য কমিশনে সার্বক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রস্তুত রাখা দরকার। কমিশনের বিশেষ তদন্ত বিভাগের অধীন দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম এ লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করবে। ওই টিমের কর্মকর্তাদের সাধারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে নিয়োজিত রাখা হবে না। কমিশনে সর্বসম্মতভাবে স্ট্রাইকিং ফোর্স বা বিশেষ টিম গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।


এই টিমের সদস্যরা রুটিন কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন। তারা শুধু বিশেষ বা বড় ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকবেন। অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করবে এ টিম।


অপরদিকে সরকারি অফিস-আদালত এমনকি অফিস সময়ের বাইরে অন্য কোথাও ঘুষ লেনদেনের ঘটনা হাতেনাতে ধরতে ছদ্মবেশে কাজ করবেন বিশেষ টিমের সদস্যরা। দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, এ ৮ সদস্যের বাইরেও স্পর্শকাতর ও উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ধরতে কমিটি প্রয়োজনীয় সংখ্যক আরও কর্মকর্তাদের কো-অপ্ট করতে পারবে।


দুদকের এই বিশেষ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার জহরুল হক বলেন, আমরা সর্বোচ্চ ভাবে চেষ্টা করছি সমাজকে দুর্নীতি মুক্ত করতে। চোখের সামনে যেসব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে বের করে নিয়ে আসতে। এ লক্ষ্যে বিশেষ টিম গঠনে কমিশন সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।


তিনি জানান, ওই টিমকে সাধারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজের বাইরে রাখা হবে। তারা শুধু বিশেষ বিশেষ জনগুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতি নিয়ে কাজ করবেন। কমিশন এজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।


দুদকের সাবেক মহাপরিচালক নূর মোহাম্মদ বিবার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থ নানাভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে, মেগা দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের যে প্রচলিত বিধি-বিধান আছে তাতে একটি অভিযোগ পাওয়ার পরে যাচাই বাছাই করে কোন অ্যাকশন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্টাইকিং ফোর্স থাকলে তাতে সুবিধা হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে কোন অ্যাকশন নেয়া যায়। দেরি হলে যারা এসব করে তারা নানারকম লিংক কাজে লাগাবে, না হয় গা ঢাকা দিতে পারে বা বিদেশে চলে যেতে পারে।


'দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছে৷ স্টাইকিং ফোর্স থাকলে যেটা হয় তাৎক্ষণিকভাবে ধরা যায়। বড় দুর্নীতির অভিযোগ আসলে প্রচলিত নিয়মে গেলে তাদের ধরাটা টাফ হয়ে যায় । তাৎক্ষণিকভাবে কোন অ্যাকশন নেয়া গেলে সেই দুর্নীতিটাকে থামানো সম্ভব,' তিনি বলেন।


নতুন গঠন করা টিমের একজন বিবার্তাকে বলেন, এই টিম শুধু মুখ দেখে নয় বরং দুর্নীতির গুরুত্ব বুঝে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কাজ করবে। এই টিমের সদস্যরা দুর্নীতির তথ্য বের করে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নেবেন। বাছাইকৃত উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ফাইলও তাদের হাতে থাকবে। তারা সময়ে সময়ে কমিশনের কাছে আপডেট তথ্য জানাবে।


এই টিমের সদস্যরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে যেন কাজকে আরো বেগবান করতে পারে সেজন্য দুদকের ল্যাবে দুর্নীতিবাজদের অনুসরণের বিভিন্ন যন্ত্র বসানো হয়েছে। তারা টেকনোলজি ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গতিবিধিও অনুসরণ করতে পারবেন।


দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বিবার্তাকে বলেন, ডাইরেক্ট একশান এরকম একটা সেন্স আমরা দিতে চাচ্ছি। দুর্নীতি হলে সেখানে দুদক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দুর্নীতিবাজদের ধরবে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় যা যা করা দরকার তা করবে।


তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছিল সেগুলো যেন রিপিট না হয় তা আমাদের বিবেচনায় থাকবে। যেই কাজগুলো করে আমরা সুফল পেয়েছি সেগুলো অধিক গুরুত্ব পাবে। যে সব কর্মকর্তাদের সামগ্রিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে, তাদের নিয়ে টিম গঠন করা হবে।


নতুন যে ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের সব ধরনের দুর্নীতি ধরার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দুদক জনগুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে বাধা থাকবে না বলেই মনে করছে দুদক।


সরকারি সেবা খাতে দুর্নীতি দমনে কাজ করতে টিম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছি। ওই টিম তিতাস, ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল, রাজউক, ডাক বিভাগ, সিভিল এভিয়েশন ও বিমান, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, বিআরটিসি, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত, স্থানীয় সরকার বিভাগসহ ২৫টি দপ্তরে দুর্নীতির বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেও কাঙ্ক্ষিত সুফল না পাওয়ার এই উদ্যোগের পথে হাঁটলো দুর্নীতি দমনের প্রধান সংস্থাটি।


প্রতিটি কমিটি ওইসব দপ্তরে কী ধরনের দুর্নীতি হয়, কীভাবে সে দুর্নীতি রোধ করা যায়- সেই সুপারিশ কমিশনে দাখিল করে। পরে কমিশন প্রতিটি সুপারিশ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে দাখিল করে। সঙ্গে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়, দুদক টিমের মাধ্যমে উঠে আসা দুর্নীতি রোধ করা না গেলে মানুষ আরও বেশি ক্ষতির শিকার হবেন। রাষ্ট্রের সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হবেন। কমিশন থেকে মন্ত্রীদের অনুরোধ করা হয়, তারা যেন স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও তার অধীন দপ্তর ও অধিদপ্তরের দুর্নীতি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন।


কিন্তু কমিশনের কোনো সুপারিশই আমলে নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। যে কারণে কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে সেসব সুপারিশ পুনরায় তুলে ধরে রাষ্ট্র এবং জনগণকে দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।


দুদকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনেও রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক সুপারিশ পেশ করা হয়। এতে বলা হয়, ঘুষ-দুর্নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উভয় পক্ষ সুবিধাভোগী। বঞ্চিত হয় শুধু রাষ্ট্র এবং সমাজ। তাই কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সংবিধানে ঘোষিত ম্যান্ডেট অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com