রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজ করতে চীন কাজ করছে বলে দাবি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
সোমবার (২৯ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে আমরা ত্রিপক্ষীয় আলোচনা করছি। চীনের সহায়তার কারণেই মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা দু-দুবার বাংলাদেশে এসেছেন, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও মিয়ানমারে গিয়েছিলেন।’
চীন চাচ্ছে যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুবই দ্রুতই শুরু হোক, সে ক্ষেত্রে রবিবার দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েডংয়ের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছে; জানতে চাইলে এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, তিনি বছর দশেক আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন। এতদিন পর এসে দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন দেখেছেন, সেই গল্পটিই বলেছেন। তখন এসে তিনি বাংলাদেশের এমন উন্নয়ন দেখেননি। তিনি পদ্মা সেতু দেখতে গিয়েছিলেন। কারণ তাদের ঠিকাদারেরাই এটিতে কাজ করেছিলেন। সেটা এবং রাস্তাঘাট দেখে তার খুব পছন্দ হয়েছে। বললেন যে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলতেই চীনা উপপরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত দেয়ার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ করছি। চীন-মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলে ত্রিপক্ষীয় আলাপ করছি।
“রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমাদের বক্তব্য বলেছি। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। সম্প্রতি আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যারা রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল দিত, তারা টাকাপয়সা কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে অনেক বেশি কমিয়ে দিয়েছে। যেমন, আগে যুক্তরাজ্য ১২৬ মিলিয়ন (১২ কোটি ৬০ লাখ) মার্কিন ডলার দিত, কিন্তু এ বছরে তারা ৫.৪ মিলিয়ন (৫৪ লাখ) ডলার দিয়েছে। আমাদের দেননি, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচআর) দিয়েছে,” যোগ করেন আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, তবে প্রতিবছর রোহিঙ্গাদের পেছনে ১.৯ বিলিয়ন (১৯০ কোটি) মার্কিন ডলার খরচ করতে হচ্ছে আমাদের। এছাড়াও অবকাঠামো বানাতে হয়েছে তাদের জন্য। সবমিলিয়ে আমরা চাই, তারা ফেরত যাক। তারা (চীন) মিয়ানমারকে নিয়ে এসেছিল। মিয়ানমারের লোকজন এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করেছিল। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ নিজ দেশে ফেরত যেতে চান, আবার কেউ কেউ কিছু দাবিও তুলেছে।
“চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো। রোহিঙ্গাদের দাবি—তারা নিজেদের গ্রামে, বাড়িতে যেতে চান। মিয়ানমার বলেছিল, তারা কিছু বাড়িঘর বানিয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের রাখতে চায়। কিন্তু রোহিঙ্গারা বলে, তারা নিজেদের বাড়িতে যাবে। তারপর মুক্ত চলাচল ও কাজের সুযোগও দাবি করেছে তারা। রোহিঙ্গারা অবশ্য চায়, তারা গেলে নাগরিকত্ব দেয়া হবে কিনা; এসব প্রশ্ন—এগুলো এখনো জঞ্জালের মধ্যেই আছে। আমার ধারণা, রোহিঙ্গাদের সুন্দর ভবিষৎ তার নিজ দেশেই সম্ভব, অন্যকোথাও তারা ধীরে ধীরে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের চেয়ে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। তারা স্থানীয়দের চাকরি-বাকরি নিয়ে নিচ্ছে। কয়েকদিন পর স্থানীয় মানুষজন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠবে। তাদের যেতে তো অনেকদিন লাগবে। আমরা বললাম, আপনাদের (চীন) কাজে আমরা খুবই খুশি। তবে সবকিছু নির্ভর করবে, ফল কী আসে, তার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, কিন্তু যে সময়ে এই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে থাকবেন। চীনকে বলেছি, ওই সময় তো সম্ভব না। তারপর নতুন করে তারা কোনো প্রস্তাব দেননি।
এ বছরেই প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করতে পারেন কিনা; জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা আমি বলতে পারব না।
জাতীয় নির্বাচনের আগে অক্টোবরে শেখ হাসিনার চীন সফরের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কিনা; প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার জানামতে কোনো বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়নি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে পাইলট প্রকল্প কবে নাগাদ শুরু হবে; প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, তাও আমরা বলতে পাবর না। শোনেন, মিয়ানমার দু-দুবার তারিখ নির্ধারণ করেছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে, কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। আন্তরিকতা না থাকলে কাজ হয় না। ওদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব আছে, নাহলে এতদিন শুরু হয়ে যেত।
আব্দুল মোমেন বলেন, মিয়ানমার প্রথম থেকেই বলে এসেছে, আমরা আমাদের লোক নিয়ে যাব। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেব। এমন পরিস্থিতি তৈরি করে দেব, যাতে তারা স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে যেতে পারেন। কিন্তু ছয় বছর পার হলেও তারা কিছু করেনি।
চীন এ ক্ষেত্রে কী আশা দিয়েছে; জানতে চাইলে তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো। যে কারণে আমাদের পক্ষ হয়ে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে চীন, আলাপ করছে। তারা বোঝে যে আমরা এগুলোকে বেশিদিন রাখতে পারব না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চীনের কাছ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা পাওয়া যায়নি।
বৈশ্বিক রোড ও ইনিশিয়েটিভ নিয়ে চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে কিনা; প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, না, এমন কোনো কথা হয়নি। তিনি এর ধারে-কাছেও নেই। তবে তারা আমাদের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। আমাদের উন্নয়নের সহযোগী হতে পেরে তারা খুশি। আরও যেসব প্রকল্প হওয়ার কথা, সেগুলো যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেই কথা বলেছেন তারা। তারা সেটি চান।
এরইমধ্যে মিয়ানমারের দুটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে, রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিরাও মিয়ানমারে গিয়েছে। চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কী কোনো আশার কথা শুনিয়েছেন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, এসব কিছু তারা সহজ করে দিচ্ছে, সহায়তা করছে। যে কারণে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এটিকে বলে আত্মবিশ্বাস তৈরি, সেটা হচ্ছে। অবশেষে হয়ত তারা (রোহিঙ্গা) যেতে শুরু করবে।
তবে কবে নাগাদ শুরু হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দোয়া করেন, কালকে গেলেই আমি খুশি। মিয়ানমার মুখে বলে তাদের নেবে, কিন্তু এখনো নেয়নি।
জাতিসংঘ বলছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে এখনো সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি; এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অনেকেই অনেক কিছু বলে। তারা নিয়ে যাক। আমেরিকার প্রতি বর্গমাইলে মাত্র নব্বইজন লোক বাস করেন, আমাদের এখানে তিন হাজার ৩০০ লোক থাকেন।
“আমেরিকার জায়গা ও সম্পদের অভাব নেই। তাদের লোক দরকার। তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে যায় না কেন! আমি সব দেশকে বলেছি রোহিঙ্গাদের নিয়ে যান। কানাডা বলল, তারা নেবে। তাদের প্রতিবর্গমাইলে পাঁচ-সাতজন থাকে, এখন পর্যন্ত মাত্র নয়জন নিয়েছে। আর আমেরিকাও নেয়ার কথা বলে মাত্র ৬২ জন নিয়েছে। কোথায় বিশ না ত্রিশ হাজার করে প্রতিবছর নেবে, তারা ধারে-কাছেও নেই,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রবিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েডংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এ কে আব্দুল মোমেন। এ সময়ে বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভের দশ বছর পূর্তির কথা উল্লেখ করে চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আশা করছি, এই বিপুল প্রকল্প থেকে বাংলাদেশের জন্যও লাভজনক হবে।
বিবার্তা/লিমন/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]