'অসাম্প্রদায়িক চেতনা— সাম্য, মানবতা ও দ্রোহের কবি নজরুল’
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ০০:০০
'অসাম্প্রদায়িক চেতনা— সাম্য, মানবতা ও দ্রোহের কবি নজরুল’
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
(কবিতা— বিদ্রোহী )


চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণি তল,অরুণ প্রাতের তরুণ দল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
( কবিতা— চল চল চল)


থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
( কবিতা— সংকল্প)


কবিতার পঙক্তিগুলো কার? উল্লেখ না করলেও অনায়াসে যে কেউ সেটি বলে দিতে পারবে। আর এই বিষয়টিই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিশেষত্ব। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মূলত তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত। তাঁর কবিতা, গান, লেখনী শুধু বাঙালিকে আনন্দই দেয়নি, বরং এদেশের লড়াই-সংগ্রামে তাঁর লেখনি জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। তাঁর সাহিত্যকর্মে উচ্চারিত হয়েছে পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের বাণী। অসামান্য ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক।


বাঙালির আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী এই কবির ১২৪তম জন্তজয়ন্তী বৃহস্পতিবার, ২৫ মে। বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন।



নিপীড়িত মানবতার বিদ্রোহী এই কবিকে নিয়ে নজরুল গবেষকসহ বিশিষ্টজনেরা বলছেন, নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা— সাম্য, মানবতা ও দ্রোহের কবি।
সারা জীবন তিনি সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরেছেন। তিনি নির্ভীক চিত্তে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার রচনা অব্যাহত রেখেছেন। থেকেছেন আপসহীন। লোভ–খ্যাতির মোহের কাছে মাথা নত করেননি। কারা নির্যাতনেও বিচ্যুত হননি লালিত আদর্শ থেকে।



জাতীয় কবির জন্মদিন নিয়ে ভাবনা জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিবার্তাকে বলেন, এদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জাতি মন্ত্রকে ধারণ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও গণযুদ্ধ সম্পন্ন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি করেছেন। ফলে এই দেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা নজরুলের কাছে ঋণী। জন্মদিনে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি যুগ যুগান্তরে আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।


কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাঁর জন্মদিন আমাদের জীবনে একটি অসাধারণ দিন। যেই দিনকে স্মরণ করে আমরা নিজেদের মূল্যবোধের জায়গাটা তৈরি করতে পারি। আর সেই অর্থে কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জীবনে এখন অবধি প্রাসঙ্গিক বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। আর আমার কাছে ব্যক্তি নজরুল গভীর ব্যঞ্জনার নাম। যিনি তাঁর দীপ্ত চেতনা নিয়ে আমাদেরকে আলোকিত করেছেন। বিশেষ করে জেন্ডার ইস্যুতে তিনি যেভাবে সময়কে তাঁর চেতনায় ধারণ করেছিলেন, তা ছিল এককথায় অনন্য। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে তাঁর কবিতায় বলেছিলেন,


“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”


তিনি বলেন, নজরুল নারী পুরুষের সমতার জায়গাটি যেভাবে ত্রিশের দশকে ধারণ করেছিলেন, তা আমাদের জীবনে এটা বড় দিক হয়ে আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে আমার জীবনের প্রদীপ্ত মানুষ মনে করি। যাঁর চেতনা ধারণ করলে নিজের মূল্যবোধকে সচেতন রাখা যায়। তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উদ্দেশ্যে তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। কাজেই নজরুলের চেতনা ধারণ করে আমরা সমাজ বিনির্মাণে করলে সেটি খুবই কার্যকর হবে।


তিনি আরো বলেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের মানবিকতাকে, চেতনাবোধকে জাগ্রত করেছেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদাকে দেখেছেন, ধর্মের দিককে আগে তুলে ধরেননি। বাঁচার অধিকারের দিকটিকে ধর্মের সুন্দর জায়গার দিক থেকে দেখেছেন। এভাবে নজরুল আমাদের সামনে সাম্যবাদের চেতনা নিয়ে এসেছেন। তাঁর কবিতা, গল্প ও গানে ধর্মীয় বা পৌরাণিক উপাদানকে তিনি শাস্ত্রের সীমিত গণ্ডি ছাপিয়ে মানবিক উচ্চতায় রূপকায়িত করেছেন। বাঙালি মুসলমান সমাজের রক্ষণশীলতার দুর্গ ভাঙতে নজরুলের অবদান তুলনারহিত ও ঐতিহাসিক।


কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় যুগস্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার যাদু স্পর্শে শুধু কবিতা নয় সংগীতেও রেখে গেছেন অতুলনীয় অবদান। আমাদের সাহস সৌন্দর্য ও শৈল্পিক অহংকারের মহত্তম নামটিও তাঁরই। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির প্রধান রূপকার এই মহান কবি আমাদের মানবিক চেতনারও প্রতীক। এজন্য তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তাঁর অমর স্মৃতি রক্ষা, তাঁর জীবন, সাহিত্য, সংগীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও প্রচার এবং তাঁর ভাব-মূর্তি দেশ-বিদেশে উজ্জ্বলরূপে তুলে ধরার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে Nazrul Institute Ordinance 1984 অনুযায়ী ধানমণ্ডির ২৮নং সড়কের ৩৩০-বি বাড়িতে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন ২০১৮’ আইনের অধীনে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।


কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব মো. রায়হান কাওছার বিবার্তাকে বলেন, জন্মদিনে জাতীয় কবিকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবতাবাদী এই কবিকে নিয়ে গবেষণার জন্য কবি নজরুল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়েছে। যার রূপকল্প (Vision) : নজরুল চেতনা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আর অভিলক্ষ্য (Mission) : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, প্রচার প্রসারের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও উৎসর্গ সাধন।



জাতীয় কবি’র ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি



জাতীয় কবির কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এবছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘অগ্নিবীণার শতবর্ষ: বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শাণিতরূপ।’ জাতীয়ভাবে এবার জন্মবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়েছে কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুরে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের আয়োজনে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। তিন দিনব্যাপি (২৫ থেকে ২৭ মে) অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী।


এছাড়াও ঢাকাসহ জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লার দৌলতপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ সম্প্রচার করবে।


বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে স্থাপিত নজরুল প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে। এ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমবেত হয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীবৃন্দ শোভাযাত্রা সহকারে সকাল ৬টা ৩০মিনিটে কবি’র সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করবেন। পরে উপাচাযের্র সভাপতিত্বে কবি’র সমাধি প্রাঙ্গণে এক আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নজরুল একাডেমী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্মবার্ষিকী উদযাপনে নজরুল একাডেমী ভবনে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে (মগবাজার মোড় বেলালাবাদ কলোনী, ঢাকা) তিনদিনব্যাপি কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এর আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করা হবে।


এদিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ’অগ্নিবীণার শতবর্ষ: বঙ্গবন্ধু চেতনার শাণিতরূপ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্রোহী এই কবির জন্মদিনে দেশব্যাপীও নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে নানাবিধ কর্মসূচি পালন করা হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com