শব্দদূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে কোথায় যাচ্ছে?
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩, ১২:২৪
শব্দদূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে কোথায় যাচ্ছে?
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

রাত ১১টা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোড এলাকার রাস্তা একদম ফাঁকা। অল্প কিছু মানুষ চলাফেরা করছেন। চলছে দুয়েকটা রিকশা। হঠাৎ পেছন থেকে অস্বভাবিক গতি আর বিকট শব্দে একটি প্রাইভেটকার পাশ কাটিয়ে গেল- যাতে আলাদা সাইলেন্সার লাগান। গাড়িটির শব্দ আশেপাশের ভবনের সাথে প্রতিফলিত হয়ে অসহ্য আওয়াজ তৈরি করছে। ফলে হচ্ছে শব্দদূষণ, ক্ষতি হচ্ছে মানুষের। অন্যের কান ঝালাপালা হলেও আরোহীর তাতে কিছু আসে-যায় না।



শুধু রাজধানীর মোহাম্মদপুর নয়, সারা দেশেই শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে শব্দ দূষণের মাত্রা, যা অনিয়ন্ত্রিত। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে শব্দদূষণ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সড়ক ও এর আশপাশের লোকজন। বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ, গাড়িচালক ও শিশুরা।



চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে শুধু কানের ক্ষতিই হচ্ছে না, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি। বধির হওয়া থেকে শুরু করে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। এমনকি হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে এতে।


শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। রাজধানীতে শব্দদূষণের বহু উৎস আছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। শব্দদূষণের অন্যতম উৎসগুলো হচ্ছে- বিভিন্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণ কাজে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার, পটকা ফোটানোর উচ্চ শব্দ, শিল্পকারখানার আওয়াজ। কোনো ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ নিয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে, তা মানা হচ্ছে না।



গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় আবাসিক অঞ্চলে গড় শব্দের মান ৯৭ ডেসিবেল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত গড় আওয়াজ স্তর মান ৫০ ডেসিবেলের অনেক ঊর্ধ্বে। উচ্চ শব্দের মাত্রা মানুষের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার প্রাব এবং করোনারি আর্টারি ডিজিজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। প্রাণীদের মধ্যে শব্দদূষণ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রজনন ও নেভিগেশনে প্রভাব ফেলতে পারে এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণ অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে।



শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল।


হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।


কিন্তু বাণিজ্যিক বা আবাসিক এলাকা তো বটেই, নীরব এলাকাতেও শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই অযাচিত শব্দের মান নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায় না।


শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা রয়েছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার একমাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) ১৯৯৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাতেও একই মাত্রাকে সহনীয় মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মানুষ (১২-৩৫ বছর বয়সী) অত্যধিক শব্দযুক্ত বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।


শব্দদূষণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৬ শতাংশ মৃত্যু হয় পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী গড় মৃত্যুর হার মাত্র ১৬ শতাংশ।


বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই শব্দের তীব্রতার সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।


পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস ও মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা।


ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান ও গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার আরাফাত সৌরভের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, শব্দদূষণের কারণে বধির হওয়া, কানে কম শোনা, মানসিক অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তা, মেজাজ খিটখিটে বা উগ্রতা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এমনকী হৃদরোগীর মৃত্যুও হতে পারে।


তিনি বলেন, শব্দদূষণের স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করলে দূষণের শিকার মানুষের কানের টিস্যুগুলো বিকল হয়ে যেতে পারে। একসময় তারা কানে কম শুনতে পান এবং নিজেরা জোরে কথা বলতে শুরু করেন।


সমাজের মানুষ ছোট থেকে বড় যে ধরনের শব্দ তৈরি করে সে দূষণে সবাই ভুগছে বলে জানান ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার আরাফাত। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে লেখা থাকে ‘এখানে হর্ন বাজানো নিষেধ’; এটা তো শব্দ দূষণের জন্য না। এটা একটা পরিবেশকে মেইনটেইন করার জন্য। যার যার অবস্থান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল যেখানে আছে তার আশেপাশে ধরেন ওয়াজ মাহফিল বা কনসার্ট করে শব্দদূষণ করা হচ্ছে, যা খুবই বিরক্তিকর। এটার একটা প্রভাব আছে। এসব কেউ মানে না, তাই এসব শব্দদূষণ হয়েই চলছে। এটা এক ধরনের সোস্যাল প্রবলেম। বিশেষ করে হাসপাতালের পাশে। যখন আমরা দেখি ঢাকা মেডিকেলের পাশে শহিদ মিনারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় অনেক মাইক নিয়ে। মাইকের ডিরেকশনটা কিন্তু বদলিয়ে দিলেই হয়। এসব শব্দদূষণে হাসপাতালের রোগীসহ আমরা ভুক্তভোগী।


ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার আরাফাত বলেন, যারা সবসময় শব্দের মধ্যে থাকে তাদের কানে বেশি সমস্যা হতে পারে। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, কনসার্টের উচ্চ শব্দে ক্ষতি কী হতে পারে, তা আমরা কখনও ভাবি না। এ ছাড়া যারা রাস্তাঘাটে সবসময় গাড়ি চালায় তারা অযথা হর্ন বাজায়। এই কয়েকটা বিষয় মানলে শব্দদূষণ হবে অনেক কম।


শব্দদূষণ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই শিক্ষক। শাহরিয়ার আরাফাত বলেন, শব্দদূষণ নিয়ে অনেকে কাজ করেছে। আমাদের চোখের সামনে অনেক স্টাডি হয়েছে, কোনোটাই আসলে অথেনটিক না। স্টাডি করার জন্য একটা প্রসেস করে দিয়েছে, কিন্তু সত্যিকারে কোনো ধরনের স্টাডি হয় না। এখানে যারা এক্সপোজারে থাকে বিশেষ করে, রিকশাচালক নিয়ে একটা থিসিস। এখন বাংলাদেশে যেহেতু কোনো স্টাডি নাই, তাই এই ব্যপারে আমাদের কোনো মন্তব্য নাই।


তিনি বলেন, যারা মেশিনারিতে কাজ করে, বিশেষ করে কারখানার পাওয়ার রুমে যারা ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে তাদের নিয়ে যদি কোনো স্টাডি হয়, দেখা যাবে ওদের প্রায় সবার কানের হিয়ারিং লস হয়েছে। এটা হচ্ছে অকুপেশনাল হিয়ারিং।


ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার আরাফাত বলেন, শব্দদূষণ বলতেই বোঝা যায় এখানে সামথিং লস। ধরেন কোন একটা ক্ষতি হয়েছে। যদি ক্ষতির পিওর স্টাডি না থাকে তাহলে এ সর্ম্পকে আমরা কিছু বলতে পারি না। তাই এখন এ বিষয়টি বিরক্তিকর বিষয় ছাড়া আর কোনো পর্যায়ের মধ্যে ফেলা যাচ্ছে না।


তবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতর কাজ করছে বলে দাবি করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ। তিনি বিবার্তাকে বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরের একটা প্রজেক্টই রয়েছে, যেটি অনেক কাজই করছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রচারণাসহ বিভিন্ন কাজ করছে পরিবেশ অধিদফতর।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com