প্রাণের ঢাকার বাতাসে বিষ
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪৯
প্রাণের ঢাকার বাতাসে বিষ
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকার বায়ু এখন বিষে পরিণত হয়েছে। পানি ছিটিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে দুই সিটি করপোরেশন। নানা তথ্য-উপাত্ত, গবেষণাও মিলেছে এমন দাবির সত্যতা-  যা ঢাকাবাসীর জন্য শুধু অস্বাস্থ্যকর নয়, অশনিসংকেতও ।


ঢাকার চারপাশের ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং ঢাকা নগরীর উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, আবর্জনার স্তূপ, ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকে অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গমন, ভবন নির্মাণ ও ভাঙার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে যত্রতত্র ফেলে রাখা, মেশিনে ইট-পাথর ভাঙা ও শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া এবং ধুলাবালি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ক্ষতিকারক গ্যাস, ভারী ধাতব কণা ও ধুলাবালি বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছে।



আর এই ভয়াবহতা সাধারণ মানুষকেও ভাবিয়ে তুলছে। তেমনই একজন আনামুল হক। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে ক্লাস করে হলে ফেরা পর্যন্ত যতগুলো গাছ দেখেছি একটি গাছের পাতাও ধুলার কারণে সবুজ নেই। কনস্ট্রাকশনের কাজ এবং অতিরিক্ত যানবাহনের কারণে এই অবস্থা হয়েছে। যানবাহন বা কনস্ট্রাকশনের কাজ তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু প্রক্টর বা ভিসি স্যারকে বলে (যদি সম্ভব হয়) অন্তত যদি প্রতিদিন ক্যাম্পাসে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতো, তাহলে অনেক বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যেতো।



সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ভেতরে বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রথমে আছে ঢাকা। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ব্রিদিং হেভি: বায়ুদূষণের নতুন তথ্য-প্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকাশ, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।



প্রতিবেদনে আরোও বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিবছরই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ এবং রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণকে বাংলাদেশে মানুষকে মৃত্যু এবং অক্ষমতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বড় ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশে ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়েছে।


প্রতিবেদনে ঢাকা ও সিলেটের ১২ হাজার ২৫০ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে বায়ুদূষণের কারণে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকায় সারাদিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি (১ দশমিক ৭) সিগারেটের সমান ক্ষতি করে।  


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয়, তা ১৩৬ শতাংশ বেশি।



গত ২০ জানুয়ারি থেকে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা এখন শীর্ষে।



কয়েকবছর আগে মন্ট্রিল ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান GHGSat এর স্যাটেলাইটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ঢাকার মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল থেকে ঘণ্টায় প্রায় চার হাজার কেজি মিথেন নিঃসরণ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৯০ হাজার গাড়ি যে পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটায়, তার সমান দূষণ ছড়াচ্ছে মাতুয়াইলের বিশাল ময়লার ভাগাড় থেকে। 


বায়ু দূষণের কারণে যেসব সমস্যা হতে পারে:


বায়ু দূষণের কারণে দুই বছরে রাজধানীতে শ্বাসতন্ত্রের রোগী বেড়েছে দেড়গুণ। বিষাক্ত বাতাস আর জনসাধারণের অসচেতনতায় প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছেন হাজারও মানুষ। শুধু বক্ষব্যাধি হাসপাতালেই প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন।


তথ্যমতে, গত অক্টোবর থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৮৮৩ জন। এ ছাড়া অক্টোবরে ১২ হাজার ২৬১, নভেম্বরে ১৪ হাজার ৬৭৪ এবং ডিসেম্বরে ১২ হাজার ৯৪৩ জন। আর চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনেই ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৮৬৮ জন। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।



শুধু তাই নয়, হাসপাতালটিতে দুই বছরে রোগী বেড়েছে দেড়গুণের বেশি। ২০২০ সালে মোট রোগী ছিল ৯১ হাজার ৪৩৪ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৪ হজার ১২০ জন এবং ২০২২ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৬৫ জন।


অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা। 


২০১৩ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক বলছে, দিনে দুটি সিগারেট খেলে মানবদেহের যে ক্ষতি হয়, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিদিন সেই পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে রাজধানীবাসীর।


জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ড. খায়রুল আনাম বিবার্তাকে জানান, ঢাকার রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে ধুলাবালির পরিমাণ অনেক বেশি। যে কারণে সুস্থ মানুষেরও কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।


পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'- এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, গত কয়েক দিন ধরে বায়ুদূষণের মাত্রা সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। এই বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। শহরের প্রতিটি নাগরিক এই বায়ুদূষণে নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।


তিনি বলেন, বায়ুদূষণের মূল কারণ নিয়ম না মেনে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ। এ ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অবহেলা রয়েছে।


বায়ুদূষণ বাংলাদেশে ভয়াবহ আকারে ধারণ করেছে। বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা 'স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার' এর প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে।


সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন না কোনভাবে বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ দূষিত এলাকায় বাস করে।


বায়ু দূষণের স্বীকার হয়ে যে দশটি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।


সংস্থাটি বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় বায়ুদূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এরমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।


বায়ু দূষণের স্বীকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিটি শিশুর ৩০ মাস করে আয়ু কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। যদিও উন্নত দেশগুলোতে এই হার গড়ে পাঁচ মাসের কম।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার দশগুণের বেশি।


ঢাকার শনির আখড়ার বাসিন্দা শামী চৌধুরী বলেন, সবসময়ে ধোঁয়া, ধুলার ভেতর দিতে যাতায়াত করার কারণে তার মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়- যা এখন চরম পর্যায় পৌঁছেছে।



সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে যেসব রোগ হতে পারে, তার মধ্যে আছে- হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট জনিত নানা রোগ, স্ট্রোক, চোখে ছানি পড়া, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা।


বায়ুর গুনগত মান শুধু শারীরিক নয়, বরং মানসিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করে। বায়ুদূষণ শুধুমাত্র এই শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে তা নয় বরং অনেক মানসিক অসুস্থতার সাথে লিংকআপ রয়েছে। বিশেষ করে হতাশা। বায়ু দূষণকারী পদার্থ মস্তিষ্কে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ বাড়ায় যা আরও বিষণ্নতা তৈরি করতে পারে। 


ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ হাইজিন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ-এ একটি ক্রস-বিভাগীয় গবেষণা প্রকাশ করেছে যে, বায়ুর প্রতিটি স্তরে নাইট্রিক অক্সাইডের পরিমান 10 µg/m3 বৃদ্ধির জন্য, বিষণ্নতার হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।  গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে  মহিলারা গর্ভাবস্থায় বা তার পরপরই বায়ু দূষণের কারণে বিষণ্নতার ঝুঁকি বেশি থাকে এবং ৬ থেকে ৭ বছরের শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধির সাথে বায়ু দূষক কণার সংযোগ রয়েছে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভুগছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সীরা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ুদূষণযুক্ত এলাকার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ নারী এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানের মানুষ বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছেন বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের দাবি।



সরকার চাইলেই দূষণ রোধ করা সম্ভব জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহ-সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন বিবার্তাকে বলেন, আমরা যেমন জানি, সরকারও জানে। গণমাধ্যমে বহুবার এসব নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। আসল বিষয় হচ্ছে সরকার এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে কি না?


ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড.আদিল মুহাম্মদ খান বিবার্তাকে বলেন, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় চলে গিয়েছে। সড়ক খনন নীতিমালার কোন প্রয়োগ নেই। পরিবেশ আইন, বিধিমালা ও নীতিমালার প্রতিপালন করবার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের ভূমিকা অতি দূর্বল। প্রভাবশালীরা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে ব্যবসা বা শিল্প-কারখানা স্থাপন করে পরিবেশকে উপেক্ষা করে নির্বিচারে বায়ু দূষণ করছে।


উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মো. রেদওয়ানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ৩০ ভাগ বনায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ঢাকা ও আশেপাশের শহরে এমন সবুজায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দূষণ রোধে সফল কলোম্বিয়ার বোগোটা, পোল্যান্ড এর ওয়ারশা, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, ঘানার আক্রা, শহরের মত ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে পাবলিক বাসের সংখ্যা বাড়ানো, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং সবুজ বাহন তথা সাইকেল ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।


পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ফরহাদুর রেজা বিবার্তার সাথে আলাপকালে বলেন, বায়ু দূষণের কারণে আমাদের আকাশের উপরিভাগে ‘ডাস্ট ডোম লেয়ার’ তৈরি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝূঁকির কারণ হতে পারে।


জাপানের মত দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশের এই ধরনের উদ্যোগ সক্ষমতার অভাবে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগ পরিবেশ দূষণ আরো বাড়তে পারে, এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।


প্রফেসর আনু মুহাম্মদ গত ২৫ জানুয়ারি তার ফেসবুকে লিখেন, ঢাকায় যে বাতাস থেকে আমরা বাঁচতে চেষ্টা করি তা এখন বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে দূষিত। ঢাকার বায়ুদূষণ এখন যে পর্যায়ে তাতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বিধি অনুযায়ী, সবার দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকার কথা, স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবার কথা। এই দূষিত বাতাসে থাকার পরিণতি কী?


আমাদের মারাত্মক সব অসুখ বিসুখ ক্রমেই বাড়ছে। শ্বাসযন্ত্র, চোখ, হৃদযন্ত্র, কিডনি, মস্তিষ্ক, পাকস্থলী, নারীর প্রজনন ক্ষমতা সবজায়গায় আঘাত পড়ছে। শিশুরা এবং মায়েরা সবচাইতে বেশি নাজুক অবস্থায়, তিনি বলেন।


তিনি বলেন, নদীকে নর্দমা বানিয়ে, খোলা জায়গা দখল করে, গাছপালা উজাড় করে, ইটের ভাটা আর নির্মাণকাজে সব অনিয়ম করে যারা এই শহরকে এই অবস্থায় এনেছে। যাদের দায়িত্ব এগুলোর সমাধান করা তাদের নাকে বুকে এই বিষ প্রবেশ করে না। তারা এসি’র বর্ম দিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং শহরকে আরও দূষিত করে।


তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ সব ভিআইপি সিআইপিদের এসি ছাড়া গাড়ি চালাতে বাধ্য করলেই এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। এটা অসম্ভব ভাবলে হবে না, এই আওয়াজ শহরের মানুষদেরই তুলতে হবে।



পানি ছিটিয়ে সামাল দিতে ব্যস্ত থাকছে ঢাকার দুই সিটি :



ভয়াবহ বায়ুদূষণ রোধে পানি ছিটিয়ে সামাল দিতে ব্যস্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ধুলা নিয়ন্ত্রণে সকাল হলেই রাজধানীর প্রধান সড়কে পানি ছিটায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি। হাইকোর্টের নির্দেশে গেল তিন বছর ধরে চলছে এই কার্যক্রম। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। 



ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা বিভিন্নভাবে তদারকি করছি। এর প্রেক্ষিতে ধুলা অনেকাংশে কমে এসেছে। কিন্তু আমাদের যে প্রত্যাশা, সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। অনুরোধ করব, রাজউকও যেন এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হয়।


জুরাইনের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমি জুরাইন থেকে বাংলামোটারে অফিস করি। পদ্মা সেতুর রেলপথ, কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেললাইন পুনঃস্থাপন চলছে। এখন ঢাকার সবচেয়ে দূষিতবায়ুর এলাকা দয়াগঞ্জ থেকে জুরাইন রেলগেইট। এখানে না ঠিকাদারা, না সিটি করপোরেশন- কেউ ভুল করেও একদিনের জন্য পানি ছিটায়নি। আমার অ্যাজমা সমস্যা আছে। এই রাস্তায় রিক্সা বা টেম্পুতে একদিন চড়লেই অসুস্থ হয়ে যাই। তাই টাকা একটু বেশি খরচ হলেও যাত্রাবাড়ি হয়ে যাই। আমি তো একদিনও দেখলাম না- যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, বাংলামোটরে পানি ছিটাতে!


বায়ুদূষণ কমাতে ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। দুটি স্প্রে ক্যানন ডিএনসিসি এলাকার মহাসড়কে পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান মেয়র আতিকুর ইসলাম।


ডিএনসিসির আওতাধীন পুরো এলাকার মহাসড়ককে দুটি ভাগে ভাগ করে একদিন অন্তর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এমন দু’টি মেশিন দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। প্রতিটি গাড়িতে ১৫ হাজার লিটার পানি ধরে এবং একটানা ৫ ঘণ্টা ব্যাপি স্প্রে করতে পারে। এছাড়া রাস্তা ভেজানোর জন্যও রয়েছে স্প্রিং লেয়ার সিস্টেম।


উল্লেখ্য, নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়। এছাড়াও অন্যান্য সংস্থা এবং মেট্রোরেল, বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য চলমান প্রকল্প ও যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ধুলাবালি সৃষ্টি হয়ে যেন বায়ুদূষণ ও পরিবেশের ক্ষতি না হয় সেজন্য সমন্বয় সভায় নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ডিএনসিসির পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়।


বায়ুদূষণ রোধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক-সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে বিবার্তাকে জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।


পরিবেশমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরে বর্তমানে কর্মরত তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের বিরুদ্ধে নগরীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। অভিযানের সংখ্যা ও পরিধি বৃদ্ধির জন্য জরুরিভিত্তিতে আরও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য প্রেরণের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। 


দেশের বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতি কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয় জানিয়ে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, বায়ুদূষণ রোধে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে কার্যকর আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মন্ত্রী জানান, বায়ুদূষণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রয়োজনে তিনি অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন। 


দেশে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুহার বাড়ছে। গত ১৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশমন্ত্রী এ কথা বলেন। 


শাহাব উদ্দিন বলেন, যেহেতু বর্তমানে বায়ুদূষণ বাংলাদেশের একটি অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা, তাই সরকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ জারি করেছে। এই বিধিমালা বাস্তবায়নসহ দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে। 


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com