অগোছালো বইমেলা: আলোকস্বল্পতা, খানাখন্দ, আবর্জনা আর ধুলার রাজ্য!
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৫১
অগোছালো বইমেলা: আলোকস্বল্পতা, খানাখন্দ, আবর্জনা আর ধুলার রাজ্য!
হাবিবুর রহমান রোমেল ও মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

বাঙালির প্রাণের উৎসব, লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা- অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছর পহেলা  ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী এ উৎসব শুরু হলেও বৈশ্বিক মহামারির কারণে গত দুই বছর যথাসময়ে বইমেলা শুরু হয়নি। তবে এবার ভাষার মাসের প্রথম দিনেই সশরীরে বইমেলা উদ্বোধন করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


ইতোমধ্যে মেলা তৃতীয় দিন শেষ করে চতুর্থ দিনে পরেছে। শুরুর চারদিনের মাথায় এসেও বইমেলা পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারেনি আয়োজকরা। মেলার দোয়েল চত্বর, টিএসসি অংশের প্রবেশ ও বাহিরের পথে লাইট এখনো বসেনি। মেলার ভেতরে আলোকস্বল্পতা, ধুলিময় পরিবেশ, অপরিচ্ছন্নতা, স্টলের কাজ চলাসহ অগোছালো অবস্থায় দেখা গেছে।



এ নিয়ে প্রকাশক ও মেলায় আগত ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছেন, বইমেলায় সবারই বাড়তি আগ্রহ থাকে। কাজেই চতুর্থ দিনেও এসেও মেলার মাঠে ময়লা-আবর্জনা, পানি না ছিটানোট কারণে ধুলিময় পরিবেশ, অনেক জায়গায় খানাখন্দ, নতুন স্টলের কাজ চলাসহ আরও নানা অসঙ্গতি সত্যিই হতাশাজনক। তবে আয়োজকরা বলছেন, অতিদ্রুত এসবের সমাধান হবে।



৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রাতে সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি অংশে সাজানো হয়েছে। এখনো উভয় অংশে কিছু স্টলের কাজ সম্পন্ন হয়নি। এসব স্টলের অবকাঠামো নির্মাণসহ চলছে সাজ-সজ্জার কাজ। কেউ পার্টিশন আনছেন, কেউ বসাচ্ছেন, আবার কেউ পেরেক মারছেন। এভাবে কাঠ, বোর্ড ও হাতুড়ির খুটখাট শব্দ গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন রাতেও চলছিল।


উদ্যান অংশের মুক্ত মঞ্চের সামনে মুক্তদেশ প্রকাশন ও সমর্থন প্রকাশনের মাঝখানে চারু সাহিত্যাঙ্গণ প্রকাশনীকে স্টল নির্মাণের কাজ করতে দেখা যায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এখানে কাজের তত্ত্বাবধানে থাকা একজনের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি নিজের পরিচয় না দিয়ে বলেন, ঢাকার বাহিরে একটা জরুরী কাজে ছিলাম। এজন্য স্টলের কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি। পরে বাংলা একাডেমির অনুমতি নিয়ে এখন স্টলের কাজ শেষ করছি।



কাজ চলমান থাকায় পাশে মুক্তদেশ প্রকাশনার প্রকাশক জাবেদ ইমন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের পাশের স্টলের কাজ এখনো চলছে। ফলে খুটুর-খাটুর শব্দে আমাদের ডিস্টার্ব হলেও মেনে নিচ্ছি। কি আর করার! কারণ, স্টলটা ফাঁকা থাকার চেয়ে খোলা হলে আমাদের জন্য সুবিধা। তখন রো'টা ক্লিয়ার হবে।



তিনি বলেন, আমাদের স্টলের সামনেসহ বিভিন্ন জায়গায় আলো অনেক কম। ফলে রাস্তাগুলো প্রায় অন্ধকারের মতো দেখাচ্ছে। 



সরেজমিনে আরও দেখা যায়, মেলার কিছু জায়গায় অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে ইট, বালু, পাথরসহ আরও নানা আবর্জনার স্তুপ। এমনকি কিছু জায়গায় মাটির স্তুপ এমন ঢিলেঢালাভাবে রয়েছে বৃষ্টি হলে কাঁদায় ভরে যাবে মেলাপ্রাঙ্গণ। উদ্যান অংশের মুক্ত মঞ্চের সামনে স্তুপ করা ময়লা-আবর্জনাও দেখা গেছে। ওখানে ল্যাম্পপোস্ট বসানোর জন্য গর্ত করা থাকলেও গতরাত পর্যন্ত এর কিছুই হয়নি। অথচ এই স্থানের আশপাশে অনেকগুলো স্টল রয়েছে। ফলে প্রকাশকরা এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।


এই স্থানে অবস্থিত আল-হামরা প্রকাশনীর প্রকাশক খান মুহাম্মদ মুরসালীন বিবার্তাকে বলেন, আমার স্টলটার সামনের কথাই যদি বলি- এই জায়গাটা তুলনামূলকভাবে অন্ধকার। এখানে ল্যাম্পপোস্টের একটা গর্তখোঁড়া থাকলেও এখনো পিলারই বসেনি। এ বিষয়ে আমি কর্তৃপক্ষকে তিনবার বলেছি। তারা আন্তরিকতার সাথে আশ্বাস দিয়েছে,  কিন্তু কাজটা এখনো হয়নি। আমি তাদেরকে বলেছি যে, আপনারা যদি ল্যাম্পপোস্ট না দেন, তাহলে এখানে যে গর্ত করেছেন, এলোমেলোভাবে পাথর রেখেছেন, সেগুলো ঠিক করেন। কারণ, এখানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আজ (শুক্রবার) এখানে অনেক ভিড় ছিল।  কখন কী হয়, বলা যায় না!



তিনি বলেন, কিছু কিছু স্টল দেখলাম এখনো বানাচ্ছে, অথচ আজ মেলার তৃতীয় দিন। অথচ ৩১ জানুয়ারির মধ্যে স্টল বানানোর কাজ শেষ করার কথা। এটা খুবই অড লাগছে।


এই প্রকাশক বলেন, মেলার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টা দেখা উচিত। যেহেতু নানা জায়গায় খোলা ময়লা রাখা, ধুলা ওড়ে- সেহেতু সময় মতো পানি ছিটালে মেলা আরও পরিচ্ছন্ন থাকবে।


পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের প্রকাশক রুম্মান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের প্রকাশনীর সামনে ল্যাম্পপোস্টের লাইট নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এখানে আলো কম। শুধু তাই নয়,২০২০ সালের মেলায় স্টলের সামনে ইট বালি বাংলা একাডেমি দিলেও এবার সেটাও দেওয়া হয়নি। ফলে স্টলের সামনের গর্তগুলো নিচের টাকা খরচ করে ঠিক করেছি। 


এই প্রকাশক বলেন, মেলায় পর্যাপ্ত আলো থাকাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা এমন হওয়া উচিত, যাতে মেলায় আগতরা অনায়াসে চলাচল করতে পারে। আর এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত। 


উদ্যান অংশের পুরো মেলা ঘুরে দেখা যায়, শুধু মুক্ত মঞ্চ এলাকায় আলো স্বল্পতা নয়, আরো নানা জায়গায় রয়েছে একই সমস্যা। উদ্যান অংশে প্রবেশের গেইট, টিএসসি অঞ্চল দিয়ে বাহিরের গেইট, মেলায় বাংলা একাডেমির স্টলের অংশে, নামাজের জায়গার আশপাশসহ বিভিন্ন জায়গায় আলোকসল্পতা রয়েছে। 



মেলার উদ্যান অংশের গেইট দিয়ে ঢুকতেই সম্প্রীতির বাংলাদেশ ও পাঠকবাড়ি প্রকাশনীর সামনের লাইট নষ্ট অবস্থায় পাওয়া যায়। কথা হয় এই দুই স্টলের সাথে। 


সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রকাশনীর বিক্রেতা মো. মাহিন বিবার্তাকে বলেন, আমাদের স্টলের সামনে নষ্ট লাইট রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বলেছি।


পাঠকবাড়ি প্রকাশক হাসানুর রশিদ বিবার্তাকে বলেন, আমাদের স্টলের সামনে লাইট নষ্ট। এছাড়া রয়েছে ধুলাবালির ছড়াছড়ি।  আমরা এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বলেছি। আমাদেরকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। জানি না, এসব কবে ঠিক করা হবে?


তিনি বলেন, অন্যান্য বারে মেলায় ছুটির দিনগুলোতে লোকসমাগমের বিষয়টি মাথায় রেখে সময় মতো পানি ছিটানো হতো৷ কিন্তু এবার ছুটির দিনে সেটা দেখলাম না! এজন্য মেলাপ্রাঙ্গণে ধুলার উপদ্রব বেশি।


বইমেলায় লাইটিং কম থাকাসহ অব্যবস্থাপনার অভিযোগের বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে  বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব ডা. কে. এম. মুজাহিদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, শুক্রবার রাতে কোথায় কোথায় লাইটিং কম তা আমি দেখে আসছি। আর ভিডিও ধারণ করেছি। এখন এসব জায়গায় পর্যাপ্ত লাইটিং পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বিশেষ করে টিএসসি অঞ্চল, বাংলা একাডেমির স্টল যেখানে রয়েছে সেখানে, মোড়ক উন্মোচনসহ বিভিন্ন জায়গায় কম। আমি বলে দিয়েছি যাতে এগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়। 



মেলার তৃতীয় দিনে এসেও কিছু স্টলের কাজ চলার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো যেসব স্টলের কাজ চলছে সেগুলোকে নোটিশ দিয়েছি। আর ইতোমধ্যে এটার দায়ে দুইটা স্টলকে বাতিল ঘোষণা করে তাদের জায়গায় অন্যদের দিয়েছি। আর ১০/১২ টা স্টলের লিস্ট করা হয়েছে। আগামীতে তারা অন্তত স্টল পাবে না।


উল্লেখ্য, বইমেলা ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলবে। তবে রাত সাড়ে আটটার পর মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যাবে না। সরকারি ছুটির দিনে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে এবং দুপুরে খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে।


এবারের বইমেলায় ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি মাঠে ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬৫টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৩৬টি স্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া এ বছর মোট ৩৮টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। 


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com