বাংলার অবিসংবাদিত নেতার ঘরে ফেরার দিন
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:১৩
বাংলার অবিসংবাদিত নেতার ঘরে ফেরার দিন
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের এই দিনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাংলার অবিসংবাদিত নেতার পদধূলিতে সেই স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি।


১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। দেশভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার মাত্রা বেড়েই চলছিলো। জাতি যখন দিকভ্রান্ত, ঠিক সেসময়ে পাকিস্তানীদের দুঃশাসন থেকে বাঙালি জাতিকে চিরতরে মুক্তি দিতে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতার আন্দোলনের পথ মসৃণ ছিলো না। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, করতে হয়েছে বারবার কারাবরণ। জীবনের স্বর্ণালী সময়ের ২৩টি বসন্ত বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তিতে আন্দোলন আর কারাগারকে বেঁছে নিয়েছিলেন তিনি।


বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬ সালের ছয় দফার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সোপান রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে তর্জনী উঁচিয়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে বাঙালিদের ওপর নির্যাতন, শোষণ বন্ধের হুশিয়ারি দেন বঙ্গবন্ধু।


বাঙালির স্বাধীনতা স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দিতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের কুখ্যাত মিয়ানওয়ালি কারাগারে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। যদিও এর আগে প্রথম প্রহরেই দূরদর্শী এ মহানায়ক দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাঙালি জাতি দখলদার পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।



নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে যখন বাঙালিরা লিপ্ত, তখন জাতির পিতা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফাঁসির আসামি হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই জাতির পিতার ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের বিজয় অর্জিত হওয়ায় সেই অভিলাষ থেকে পিছু হটতে হয় ইয়াহিয়া খানকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর নেতার মুক্তি দাবিতে জেগে উঠেছিলো বাঙালি, সোচ্চার হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতারা। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।


মুক্তিযুদ্ধে বির্জয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে”। সেই থেকে প্রতিবছর কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি নানা আয়োজনে পালন করে আসছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।


যেভাবে দেশে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু:
বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলীর কাছে বার্তা পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজস্থ হাবীব আলীর বাসভবনে নিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। এসময় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন স্বাধীন বাংলায় ফিরে তিনি তার সিদ্ধান্ত জানাবেন।


১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে পাকিস্তান থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ভিআইপি লাউঞ্জে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা স্বাগত জানান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি।



এ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবো। আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন স্বদেশে ফেরার জন্য ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে রওনা দেন তিনি। দেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে দিল্লীতে। সেখানেও তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়।ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এসময় বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন বাংলার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী বিমান।


বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য নেতারা পুষ্পমাল্য হাতে ছুটে যান প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে। মাল্যভূষিত হওয়ার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন বঙ্গবন্ধু। জাতির জনক স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এসময় বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হন লাখো জনতা।


এরপর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতাদের নিয়ে ট্রাকে করে রওয়ানা দেন বঙ্গবন্ধু। রাজপথের দুই পার্শ্বে দাঁড়ানো জনসমুদ্রের কারণে ৬ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতেই সময় লেগে যায় দুই ঘন্টারও বেশি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে লাখ লাখ রেসকোর্স ময়দানে অপেক্ষমাণ জনতার জনসমুদ্রে পৌঁছান রাজনীতির মহাকবি। লাখো জনতা সেখানে তাঁকে স্বাগত জানায়। এরপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।


বিবার্তা/সোহেল/বিএম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com