
ক্রিস্টোফার বলতো, ও রোদের কথা শুনতে পায়।
আমরা হাসতাম। ক্রিস্টোফার পেরেইরা, আমাদের স্কুল ফ্রেন্ড, ব্যাপটিস্ট ক্রিশ্চিয়ান, সিল্কি লাইট ব্রাউনিশ হেয়ার, কাঁধ অবধি গড়ানো, মুখের হালকা দাড়িতে ওকে অনেকটা জর্জ হ্যারিসন যেমন অল্প বয়সে ছিলেন দেখতে, তেমনটা লাগতো।
ও না পারতো গান গাইতে, না পারতো গিটার বাজাতে। তবে নিমগ্নতা ছিলো ওর, আত্মনিমগ্নতা।
অন্যদিকে আমরা ছিলাম ছটফটে, অস্থির। আমাদের তাড়া ছিলো অকারণ ছুটোছুটির। আমরা যখন হুল্লোরে ব্যস্ত, তখনও ক্রিস্টোফার একা, চুপচাপ ওর পায়ের কাছে আদুরে বিড়ালের মতো গুটিশুটি শুয়ে থাকা রোদের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতো।
আমরা জানতাম না রোদ কথা বলতে পারে কি না, জানতাম না রোদের কোনো ভাষা আছে কিনা আদৌ, কিন্তু ক্রিস্টোফার বলতো মৌনতার নিজস্ব বর্ণমালা আছে, আছে একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাকরণ, অনুভূতি প্রখর হলে তাকে শুনতে পারা যায়, যদ্দুর বুঝতাম রোদকে ভালোবাসতো ও, ক্রিস্টোফার বলতো ভালোবাসতে জানলে অনুভূতি প্রখর হয়।
আমরা মাঝে মাঝে চেষ্টা করতাম ভালোবাসতে, চেষ্টা করতাম রোদের কথা শুনতে, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিলো না, আমরা যেহেতু ক্রিস্টোফার ছিলাম না, যেহেতু আমাদের একাগ্রতা ছিলো না, যেহেতু আমরা ছিলাম কোনো নির্দিষ্ট কিছুতে অভিনিবিষ্ট হতে অক্ষম।
আমাদের সাথে ক্রিস্টোফারের এক গোলার্ধ সমান দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা ছিলাম বন্ধু, ওর নীরব হাসির সাথে আমাদের কার্যকারণহীন অট্টহাসি মিলে মিশে যেতো খুব সহজেই।
আমরা একসাথে বড়ো হচ্ছিলাম, আমাদের পা'জোড়া লম্বা হচ্ছিলো ক্রমশ, আমরা ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে শিখছিলাম, আমাদের পৃথিবীর পরিধি বাড়ছিলো দ্রতবেগে, শুধু ক্রিস্টোফার তার পৃথিবীর পরিধিকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলো রোদকে ঘিরে, যতো দিন যাচ্ছিলো রোদের কথা আরও অনেক বেশি শুনতে পাচ্ছিলো ও, যতো দিন যাচ্ছিলো রোদের সাথে অন্তরঙ্গতা বাড়ছিলো ওর, যতো দিন যাচ্ছিলো রোদকে আরও বেশি বেশি ভালোবাসছিলো ক্রিস্টোফার।
আমরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে ও স্বভাবসুলভ মুচকি হাসতো, ওকে আমাদের বয়সের চাইতে অনেক বেশি পরিণত মনে হতো, যদিও আমরা এতো ভাবতাম না এসব নিয়ে, আমাদের ভাবনার বিষয়ের অভাব ছিলো না, উপরন্তু নতুন নতুন ভাবনা এসে প্রতিনিয়ত প্রতিস্থাপিত করতো পুরোনো ভাবনাকে।
একবার এক গ্রহণকালে রোদের মৃত্যু হলো, আমাদের বন্ধু ক্রিস্টোফারের মুচকি হাসিটার কথা বেশ মনে আছে এখনও, রোদের সাথে ওর জন্মান্তরের সম্পর্ক ছিলো কিনা জানি না, তবে ক্রিস্টোফার বেঁচে থাকার অর্থ হারিয়ে ফেলেছিলো, আমাদের বন্ধু ক্রিস্টোফার বেছে নিয়েছিলো মৃত্যুকে, যদিও পরবর্তীতে পুনরায় রোদ জন্মেছিলো যথানিয়মেই, আমাদের বন্ধু ক্রিস্টোফার শুধু জন্মায়নি আর।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]