
মরণ, মরণ
মরণ,
করো নিখিলের অমৃত পান।
হও দৈব, সর্বৈব।
জান্তব, দানব
পরম্পরায় অবিমিশ্রিত সত্যের সত্তে।
অর্ফিউসের তাণ্ডবছলে ঊর্ধ্বরথে তোলো ধরণীর পরিহাস।
হে মরণ,
রণরঙ্গে, তূর্যে সূর্যে ধারণ করো
মত্ত, উত্তপ্ত মৃত হৃত জনমের পরাঘাত।
চন্দ্রে যাচিত দানবিক, পাশবিক, মানবিক ভণ্ড জোচ্চোর
তোমা পানে হোক বিসর্জিত, বিবর্জিত, অর্জিত নির্বীজের সমাধিগির্জায়।
মরণ মম,
শিকড়ে শিখরে মগন গগন বণ্টিত, উৎকণ্ঠিত যবে
তুমি এসো ধরি কাপালিকের জটাপথ,
তন্ত্রে, মন্ত্রে, যন্ত্রে দেখা দিক শখের শোকের পরমব্রক্ষ্ম।
রিক্ত তিক্ত জীবনের স্বাদ, যতো আকাঙ্ক্ষিত সাধ
নাচন মোচন করো তোমার স্তম্ভিত প্রলম্বিত ক্লেদের ক্ষেদে।
হায় মরণ,
মগ্ন, ভগ্ন যতো পুণ্য, শূন্য চরাচর
মুগ্ধ, বিক্ষুব্ধ ছলছল কলরোষে
তোমার প্রান্তে, পদাক্রান্তে নিক
শ্মশানবাহিত অগ্নিদাহিত মজ্জাশয্যাসজ্জা।
মরণ তুমি—
স্মরণশরণে মাতো, পাতো হাত, মিথ্যের দিনাতিপাতে।
উদ্বেলিত উদ্বাহিত মল্লারহুল্লোড়ে,
নেমে এসো রাহুর বাহুডোরে,
ঊষর ধূসর মর্মরিত ভোরে।
হোক চন্দ্রমন্দ্র সন্তাপের সন্তরণ,
নষ্ট ভ্রষ্ট লোকালয় হোক তব দ্রোহের ভূমি।
ধিক্কারের ওঙ্কারে অঙ্কিত প্রকম্পিত হোক
সৃষ্টির চিৎকার, শীৎকার।
ত্যাগ করে এসো আত্মসংবরণ।
ক্ষোভের লোভে করো তাপ, পাপ, অভিশাপ মহাহরণ।
মরণ, মরণ!
(নজরুলের প্রতি নিবেদন)
আত্মহনন
জগতের যাবতীয় হ্যালুসিনেশন আমার হোক।
যক্ষ্মা বাসা বাঁধুক বুকের হাড়ে, হাড়ের মজ্জায়।
ফুসফুসের পুটুলিগুলো ভরে যাক বিষে,
জগতের সকল ঘোরলাগা ভোরে অনিদ্রা ভর করুক আমার চোখে
মাটির করোটির প্রতিটি সিন্যাপসিস হোক যন্ত্রণাবাহী,
যতো আছে অস্থিসন্ধির দাগ,
মিশে যাক, পিষে যাক; ক্লিশে হোক বোধ,
ক্রোধে ও রোধে ছিঁড়ে যাক ধমনী অবনীর অমনিবাশে।
জগতের সকল আত্মহনন আমার জন্য সরণি গড়ুক।
অবরুদ্ধ যতো মাতমদোলা, শোক ও শক্তির আস্বাদন,
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখুক মারণব্যাধির আচ্ছাদন।
রক্তধারায় ভেলা ভাসাক খুনমন্ত্রের প্রেতশরীর
আর স্নায়ুর কুটিরে ঘুণ জমুক অগুন্য অনিঃশ্বাসে।
মরণ আসুক,
মরণ আসুক,
যোনীমোহের ঊর্ধ্বে এসে মরণ আমায় ভালোবাসুক।
জগতের সকল বিবমিষা থাক আমার ঘরের ফুলদানিতে,
ঝালরবাতি, শঙ্খধ্বনি, উলুখাগড়ার ব্যালকনিতে।
(নজরুলের প্রতি নিবেদন)
দাহকাল, মোহজাল
জলের ফোঁটা প্রেমের মতো ঠোঁটের, বুকের নরমে।
দিন কেটে যায়, রাত্রি নামে ভালোবাসার গরমে।
দাহকালে শরীর কাঁপে আঙুলেরই ছোঁয়ায়
সুখতৃপ্তির শীতল পরশ ক্ষুধাতৃষ্ণা ধোয়ায়।
সুধাবারি বর্ষিত হয় গৃহতাপের চরমে।
রসধারা একাকার হয় মিলেমিশে মরমে।
শরীরজুড়ে মাতম নামে, উষ্ণ আঁচের দোলায়
স্পর্শ করে নরম পিয়াস দহনজ্বালা ভোলায়।
জলের ফোঁটা প্রেমের মতো ঠোঁটের, বুকের গরমে
দিন কেটে যায়, রাত্রি নামে ভালোবাসার নরমে।
আমি সেজে বসে থাকি অপেক্ষাপ্রহরে
একটা দিনের হিসাব জমে, আটকে থাকা বুকের দমে
দিন ফুরোলেই জীবন শুধায়, শরীর-মনে কতটা ক্ষুধায়
যে ভুলে যায়, সে ভালো রয়,
দেখছে না তো কোথায় কী ক্ষয়
জানছে না তো হাজিরা খাতায় কোন রঙে দাগ পড়ে।
একটা আকাশ আঁধারে লুকায়
মেঘের বৃষ্টি হাওয়ায় শুকায়
আমি তবু ঘড়ার জলে তাপ দিয়ে যাই ঘরে।
একটা মানুষ রোজ চলে যায়, ক্লান্ত, শান্ত নীরব পায়ে
আমি সেজে বসে থাকি অপেক্ষাপ্রহরে।
একটা ভ্রমর মধুর নেশায়, এক বাগানে রোজ ঘুরে যায়
রোদজুড়ে ধায়, বোধ ফুঁড়ে খায়
আমি শুধু মালির মতো সেচ দিয়ে যাই গাছের গোড়ায়
ফুল ফুটে হায়, ফুল ঝরে যায়,
পাতায় পাতায় জমে থাকে লালার তৃষা ভরে।
সন্ধ্যে হলেই গাছের পাতায়
গিরগিটি তার ঘরটি মাতায়
ছেলেখেলায় হেলাফেলায় মিথ্যে কিছু স্বপ্ন দেখায়
আমি তবু চোখটি বুজে রং মেখে যাই শুধু।
একটা খাতা শূন্য কত, শব্দ জমে শত শত
ডাকঘরে তার চিঠি আসে
প্রজাপতি আর তুলোর মতো
দিন ফুরোলেই বন্ধ খাতা,
বলতেই হয়, ওসব যা-তা
একটা পিয়ন বার্তা বিলায় চোখ এড়িয়ে নত
আমি শুধু কান পেতে রই, তার পায়ের আওয়াজ না তো?
একটা নদী পাল্টে গতি, তীরের পানে ছোটে
ঘণ্টা বাজার সময় হলেই কচুরিপানা জোটে
সূর্য ডুবে জানান দিলেই
ঝাঁপিয়ে পড়ি নীলাভ ঝিলেই
একা একা ক্ষণ গুনে যাই সারাটি রাত ধরে
একটা মাঝি নৌকা লুকায়
পালতোলা ছই না দেখা যায়
আমি শুধু ঢেউ গুনে যাই আধেক ঘুমঘোরে।
একটা পাখি দিন কাটিয়ে ডানা গুটায় অন্য নীড়ে
আমি তবু বসে থাকি খড়কুটো তার আগলে ধরে
দিন ফুরোলেই ভয়ে কাবু
শিকারি বনে গাঁড়ছে তাঁবু
সেই পাখিটার মগ্ন ডানায় তৃষ্ণা লেগে রয়।
অন্য পাখি শরীর সাজায় অপেক্ষাপ্রহরে।
তুমি ছাড়া আমার কোনো ঘর নেই
ঘরে ফিরে আমার মনে হয়,
তোমার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই।
যেন তুমি ছাড়া আমার কোনো ঘর নেই,
যেন তোমাকে ছাড়া আমার চরাচরে আর কোনো মানুষ নেই, সহচর নেই।
যেন তোমার,
শুধু তোমার অপেক্ষাতেই
আমি কাটিয়ে দিতে পারি সহস্র জন্মের রেশ অনিমেষ,
যেন তোমার দিকে যাওয়ার জন্যই আমি হেঁটে যেতে পারি এমনকি জন্মান্তরের অনন্ত পথ,
তোমূর জন্যই পাড়ি দিতে পারি নিঃসীম শূন্যের পুলসিরাত।
ঘরে ফিরে আমার মনে হয়,
এই ঘরে আমি আসি তোমার হাত ধরে যেন
এইটুকু তোমার থাকার আবেশ আমাকে আগলে জড়িয়ে উষ্ণতা দেয়
কোথাও কেউ না থাকার বিষাক্ত ছোবল থেকে।
যেন তোমারই জন্য চোখভরা জল নিয়ে অপেক্ষা করি
কখন তুমি এসে দুচোখে মাখিয়ে দেবে নতুন করে সূর্য দেখার বাসনার রেণু।
ঘরের ভেতর আমি তাকিয়ে থাকি মিথ্যে বেড়ার দেয়ালগুলোর দিকে
যেন এখনই চোখের পলকে দেয়াল ফুঁড়ে তুমি বেরিয়ে আসবে
এঁকে দেবে হাসি।
ঘরে ফিরে আমার মনে হয়
তোমাকে, শুধু তোমাকেই দিনশেষে পাব বলে
আমি দুর্বিনীতের মতো মাড়িয়ে আসি অসংখ্য ছলাকলার অযুত ভনিতা।
কাটিয়ে আসি নিযুত মিথ্যে বেঁচে থাকার জীবন।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]