সাক্ষাতকার
'৩৬৫ দিনের প্রতিদিনই আমার কাছে শোকের দিন'- বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৩:৫৬
'৩৬৫ দিনের প্রতিদিনই আমার কাছে শোকের দিন'- বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক উচ্চবিলাসী, বিপথগামী, ক্ষমতালিপ্সু সদস্য। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সেই সময়ে রাজশাহী অঞ্চলে প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওই সময় দীর্ঘ ৫ বছর কারাভোগ করে মুক্তি পান তিনি।


বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার দিন ঢাকায় ছিলেন নাটোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন ও পরবর্তী সময়ে রাজধানী ঢাকা ও রাজশাহীর পরিস্থিতি কেমন ছিল? এ নিয়ে সম্প্রতি বিবার্তার সাথে মুঠোফোনে কথা বলেছেন আব্দুল কুদ্দুস। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো।


বিবার্তা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপনি ঢাকায় ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাই।


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: এটা কাকতালীয় ব্যাপার ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল চালু করলেন- প্রত্যেক জেলায় গভর্নর সিস্টেম চালু করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। ওই সময়ে সাংবিধানিক আইন ছিল যে, পার্লামেন্টের সকল সদস্যকে বাকশালে যোগদান করতে হবে। যারা যোগদান করবে না, তাদের সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। রাজশাহী অঞ্চলে মাইনুদ্দিন মানিক নামে জাসদের সংসদ সদস্য ছিল। সে বাকশালে যোগ না দিলে সদস্য পদ চলে যায়। পরে উপ-নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে মোহাম্মদ মহসিন সাহেব প্রার্থী ছিলেন। তিনি জয় লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তখন আমি এই অঞ্চল দেখাশোনা করতাম। আগস্টের ১৪ তারিখে উনার ঢাকাতে শপথগ্রহণ ছিল। আমি সাথে করে উনাকে ঢাকায় নিয়ে এলাম। তখন স্পিকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। উনার রুমে শপথ হলো। এখন এমপি সাহেবদের অফিস করেছে, তখন এমপি সাহেবদের আবাসিক হোস্টেল ছিল। ৬নং ব্লকের একটি ভবনের নিচতলায় মহসিন সাহেবের রুম হয়েছিল। সেখানে আমরা ছিলাম।


বিবার্তা: বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার খবর কখন পেয়েছিলেন?


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: ১৫ আগস্ট ভোরবেলা বাথরুমে যাবো বলে ঘুম থেকে উঠেছি, সেই সময় এমপ্লয়ার্সদের রুমের রেডিওতে একটা ঘোষণা আসে। খুনি ডালিম ঘোষণা করে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন ওই অবস্থায় আমি বেরিয়ে পড়ি। পরে ফার্মগেটের ভেতর দিয়ে ৩২ নম্বরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। পরে ধানমন্ডি ২ নম্বরে কামরুজ্জামান সাহেবের বাসায় গেলাম, উনি তখন বাসায় ছিলেন না। ভাবি বললেন, উনি ধানমন্ডি ৭ নম্বর। ওখানে গিয়ে খুব কান্নাকাটি হলো। উনি তিনটি চিঠি লিখলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেব ও তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে। তাজউদ্দিন সাহেবকে আর্মি ঘিরে রেখেছিল। আমি চিঠি নিয়ে মিন্টু রোডে ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবের কাছে গেলাম। ওখানে গিয়ে তাকে পাইনি। পরে টি এন্ড টি কলোনিতে দেখা করলাম। বললাম, স্যার আপনি তো প্রধানমন্ত্রী। উনি বললেন, দেখো কুদ্দুস সব আর্মি... যারা এটাকে ট্যাকেল দিবে তারা কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। এরপর গেলাম সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে। বললাম, আপনি তো ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একটা কিছু... । উনি বললেন, আমরা তো যোগাযোগই করতে পারছি না।


১৬ তারিখে কামরুজ্জামান হেনা ভাইয়ের ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি চারজন আর্মি অফিসার। খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ আর রক্ষীবাহিনীর দেলোয়ার সাহেব। এরা হেনা ভাইকে বলছে, স্যার একটা ম্যাসাকার তো হয়ে গেল। আপনার যেসব লোকজন ঢাকায় আছে তাদের স্ব স্ব এলাকায় যাইতে বলেন। দেখি আমরা কিছু করতে পারি কি-না। হেনা ভাই আমাকে বললো, তুই রাজশাহী চলে যা।


বিবার্তা: আপনি কি করলেন?


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: আমি ১৭ আগস্ট প্লেনে রাজশাহীর ইশ্বরদী চলে যাই। এয়ারপোর্টে ১০০-১৫০ আর্মি পাহারায় ছিল। বিডিআর-এর চিফ ছিল। তিনি বললেন, আপনার তো সাহস কম না। সব রাজশাহী ছেড়ে পালাচ্ছে আর আপনি রাজশাহী আসছেন। কারণটা কী? বিমানের কিছু মাইক্রোবাস ছিল। ড্রাইভারদের সব ছিল আওয়ামী লীগ পন্থী। গাড়িতে ড্রাইভার পাসের সিটে বসলাম। ড্রাইভার বললো, এই পরিস্থিতিতে আপনি কেন আসলেন। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নাই। বাড়ি পৌঁছায় দাও।


বাড়ি ফিরার পর শাশুড়ি বললেন, এই কামটা তুমি ১৯৭১ সালে করছিলা। সারাদেশে অভিযান শুরু হইছে ২৫ তারিখে, আর এখানে তোমার কারণে শুরু হইছিল ১ তারিখে। আর্মিরা এসে তছনছ করেছিল। আবার এই কামটা কি করে করলা। আমি বললাম- এমনি আসছি। পরে খাওয়া-দাওয়া করে পুলিশ লাইনে গেলাম, রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। কর্নেল নওয়াজিশ ছিল, বিডিআর চিফ আব্দুর রশিদ ছিলেন- আলাপ করলাম। ডিসি ছিল শফিউর রহমান। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো- ১৮ তারিখ চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিডিআর ক্যাম্প গিয়ে রিপোর্ট জানাব। ওখান থেকে ইন্ডিয়ায় যোগাযোগ করে আমরা একটা বিদ্রোহ করব। তখনকার ডিসি অফিসের সিএ ছিল আব্দুর রহীম। যদিও সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। সে এই খবরটা এসপি আবু তালেবের কাছে আউট করে দিছে। সে খন্দকার মুশতাককে বলেছে। সাথেই সাথেই অর্ডার আসলো- এরেস্ট হিম।


বিবার্তা: এরপর কি হলো?


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রতিবাদ করায় ১৭ আগস্ট আমাকে গ্রেফতার করে বোয়ালিয়া থানায় থানায় নিয়ে যায়। ১৮ তারিখ সকালে এসপি আবু তালেব কাছে বসা। হঠাৎ করে বলে উঠল- কই, আপনাদের জাতির পিতা কই? আমি দাঁড়াইয়া গেছি। বলি, আপনি এসপি হইছেন কার দয়ায়? উনি বলে, ও কথা ভুলে যান। এ কথা কখনোই ভুলব না। যখনই এই কথা বলছি তালেব বলে, এই এরে হাজতখানায় ঢুকা, এরে বাইরে বসায় রাখছ কেন? ওই অবস্থাতেই খপ করে এসপি’র কলারে ধরছি। বলে, সাহস তো কম না। আমি বলি, সাহসের জন্য দেশ স্বাধীন হইছে। আপনি একটা কলাবেরটর, এসপি হইছেন। বঙ্গবন্ধুর মারিছেন। এঘটনার পর আমাকে থার্ড ডিগ্রি দেয়ার নির্দেশ দিলো তালেব।


এ ঘটনা আর্মি জেনে গেছে। এসপিরে এসে বলছে, ইউ বাস্টার্ড, কলাবেরটর, পাকিস্তানি। আর্মিরা ক্ষমতা নিছে। আর্মিদের ব্যাপার আপনাদের কি? একজন মুক্তিযোদ্ধা মানুষ, কুদ্দুসকে আপনি জানেন না। আজকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করা হলে বাপ বাপ করতেন। তাই এখানে আমাকে রাখা যাবে না। পরে উনার আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া গেল। ওখানে নিয়ে অফিসার্স মেসে রাখল। এরপর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিল। নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আমার কাছে অস্ত্র চাইল। আমি বলি অস্ত্র কোথায় পাব? অস্ত্র তো কয়েকবার জমা দিছি। আমি কি কারখানার মালিক নাকি। ওরা আমার কথায় খালি মারে। একটা বিভৎস রুমে আমাকে পা উপর দিয়ে ঝুলাইল। গরম পানি, শুকনা মরিচের গুড়া দিয়ে নাকের মধ্যে ঢুকাইছে। ওখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ছিল। উনি বলল, মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস জীবন। তার কাছ যদি কিছু থাকত, তাইলে বলে দিতো। কি মনে করে আর মারেনি।


আবার রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দিল। ওখানে গিয়ে শুনি আমি ৯ জন রাজাকার হত্যার একক আসামি। প্রটেকশনে ট্রাইবুনালে হাজির করল। ওখানে একজন কর্নেল একজন মেজর আর দেলোয়ার সাহেব ছিল। অভিযোগ পড়ে শোনাল। অভিযোগ শুনে আমি বলি- এগুলো সব মিথ্যা বানোয়াট। একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি রাজাকারদের মেরে দেয় তো সঠিক কাজই করেছে।


পরে আবার রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। ওখানে বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি করায় সুবেদার হাবিবুর রহমানকে মারলাম। এরপর সেখান থেকে সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ঘুরিয়ে আবার রাজশাহী জেলে। এরপর বিচার শুরু হলো। পরে খালাস পেয়েছি। ওই সময় সবচেয়ে বেশি মোট ৫৯ মাস ১৭ দিন জেল খেটেছি।


বিবার্তা: আমরা শুনেছি ১৫ আগস্ট আসলে আপনি রোজা রাখেন।


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবার যেভাবে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ঘটনা ঘটিয়েছিল। আমার কাছে বাংলাদেশের ১২ মাসই ১৫ আগস্ট। বছরের ৩৬৫ দিনের প্রতিটি দিনই আমার কাছে শোকের দিন।


বিবার্তা: বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা খুনিদের অনেকে এখনো পলাতক। তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের বর্তমান তৎপরতা কি যথেষ্ট?


বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস এমপি: বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। খুনি জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি জারি করেছিল খন্দকার মোশতাকসহ। যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হবে না। সেই ইনডেমনিটি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাতিল করা হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ২০০৯ জানুয়ারির ৬ তারিখে সরকার গঠন করে উনি (শেখ হাসিনা) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরও বিচার হয়েছে। এখন যারা পলাতক আছে সেই পলাতকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনীতিকভাবে বহু লড়াই-সংগ্রাম হচ্ছে। তারপরেও কর্নেল ফারুকের ফাঁসি হয়েছে। জনগণ যদি আবার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং উনি যদি বেঁচে থাকেন সেই পলাতক খুঁনিদের ফেরৎ আনতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। এর জন্য হলেও উনাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এজন্য থাকতে হবে ইফ দ্যায়ার হেভ বিন নো শেখ মুজিব, দ্যায়ার হেড বিন নো বাংলাদেশ। ইফ দ্যায়ার হেভ বিন নো শেখ হাসিনা, দ্যায়ার হেড বিন নো বাংলাদেশ। কারণ এই দু'জনের সাথে এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য, স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও দেশপ্রেম জড়িত।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com