সাক্ষাতকার
সব পেশাকে সমমর্যাদার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে: ড. আরেফিন সিদ্দিক
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৪:১১
সব পেশাকে সমমর্যাদার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে: ড. আরেফিন সিদ্দিক
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

৪১তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট পিএসসির ওয়েবসাইটে এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এই বিসিএসে দুই হাজার ৫২০ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রকাশিত এই ফলাফলে ভালো ক্যাডারগুলোতে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারসহ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের খবরও সামনে এসেছে। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত এই বিসিএস পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের ৫০ শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। আর এই হলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের। ফলে এর মাধ্যমে বিসিএসে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের সফলতার বিষয়টি স্পষ্ট।


টেকনিক্যালসহ সব দিকের শিক্ষার্থীরা এখন বিসিএস কেন্দ্রিক হয়ে গিয়ে সফল হলেও এই বিষয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবাই বিসিএসমুখী হয়ে গেলে টেকনিক্যাল কাজগুলো করবে কারা? তাছাড়া টেকনিক্যাল শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের যে ইনভেস্ট, সেটারও যথার্থ প্রয়োগ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বিসিএসের মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতির বিষয়ে বিবার্তা২৪ ডটনেটের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবু আহসান মো. সামসুল আরেফিন সিদ্দিক। যিনি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক নামে সমধিক পরিচিত।


গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথিতযশা এই অধ্যাপক বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাসেল।


বিবার্তা: সবার লক্ষ্য কেন বিসিএস?


ড. আরেফিন সিদ্দিক: দেখুন- বিসিএসের অনেকগুলো পোস্ট প্রশাসন সম্পর্কিত। কাজেই এগুলোতে সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি থাকে। তাছাড়া বিসিএস ক্যাডার হলে সামাজিক মর্যাদা বাড়বে, এই রকম একটা মনমানসিকতা আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাথায় গেঁথে আছে। তাই সুযোগ-সুবিধা ও সম্মানের কথা বিবেচনায় বিসিএস তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণের বিষয় হতে পারে। বর্তমানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ নানা টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিতরাও এদিকে ঝুঁকছে আর সফলও হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের তাদের অভিনন্দন জানানো উচিত। তারপরেও কিছু বিষয় থেকেই যায়। কেন তারা এদিকে ঝুঁকছে সেটাই ভাববার বিষয়।


বিবার্তা: বিসিএস শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে কি-না? একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আপনি কী মনে করেন?


ড. আরেফিন সিদ্দিক: বিসিএস শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এটা আমি বলবো না। তবে আমি এটা বলতে চাই, অন্যান্য পেশার মানমর্যাদা অবশ্যই বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় আমি অবলীলায় বলতে চাই কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারসহ নানা পেশায় হয়তো ঘাটতি আছে। আর এই ঘাটতি সুযোগ-সুবিধার কিংবা ক্ষমতার হতে পারে। তা না হলে সবাই বিসিএসের প্রতি ঝুঁকবে কেন? সব পেশার মধ্যে সমতা আনতে হবে। তবে এটা ঠিক যে, সমতা বজায় রাখা কঠিনও। সেক্ষেত্রে পুরোপুরি সমতা না হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে কেউ অন্য দিকে যাবে না।


বিবার্তা: ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা বিসিএসে এসে পেশা পরিবর্তন করে ফেললে তখন ওই টেকনিক্যাল পেশাগুলোর উপরও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?


ড. আরেফিন সিদ্দিক : দেখুন, বিসিএস ছাড়াও কিন্তু এসব পেশার অনেকে বিদেশ চলে যায় কিংবা নিজ পেশায় না থেকে অন্য কিছু করে। এটা আগেও ছিল, আর এখনও আছে। তবে বিসিএসের প্রতি তাদের আগ্রহ দিনকে দিন বাড়ছে, এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আমি মনে করি, কেউ যদি বিদেশ গিয়ে গবেষণাসহ নানা অর্জন দেখিয়ে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে, সেটা দোষের কিছু না। একইসাথে কেউ যদি টেকনিক্যাল পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় গিয়ে নিজের সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারে অর্থাৎ চাহিদা মাফিক সেবা দিতে পারে, সেটাকে আমরা খারাপ বলবো কী করে? তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়? তাহলে তারা এতোদিন ঐসব পড়াশোনা কেন করলো? এটার উত্তর হলো- কেন টেকনিক্যাল পেশায় থাকছে না, সেটা খুঁজে বের করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।


বিবার্তা: বিসিএস নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাতামাতি কাটিয়ে উঠতে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?


ড. আরেফিন সিদ্দিক: সকল পেশাকে সম মর্যাদার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার।


বিবার্তা : শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায়ও আসতে চায় না। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?


ড. আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশা নিতে চায় না, এর পেছনে নানা কারণ আছে। প্রথম কথা হলো, শিক্ষকতার মূল্যায়নটা সামাজিকভাবে আমরা সেভাবে করতে পারেনি। শিক্ষকদের বেতন ভাতাও আমরা কম দেই। অন্যান্য সেক্টর থেকে এই সেক্টরে শিক্ষকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও কম। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ও সরকারি কলেজ পর্যায়ে কিছুটা সামঞ্জস্য আছে অন্যান্য পেশার সাথে। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশার বেতন ভাতা অনেক কম দেয়া হয়। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশার চেয়ে অন্যান্য পেশাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি কেরানীর চাকরিসহ অনেক চাকরির স্থায়িত্ব বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থাকায় এসবেরও গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। শুধু ‍তাই নয়, সরকারি অন্যান্য চাকরির গুরুত্ব সমাজে বেড়ে যাওয়াসহ সামাজিক নানা কারণে শিক্ষার্থীরা এখন আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না।


বিবার্তা : শিক্ষকতা পেশার এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা?


ড. আরেফিন সিদ্দিক : আসলে সত্যিই বলতে, শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ সম্মানের পেশা করা উচিত ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগতভাবেও তাদেরকে খুব মর্যাদা দিতেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে আমরা শিক্ষকদের সেভাবে মর্যাদা দিতে পারিনি, সেটা আমাদের-ই ব্যর্থতা। শিক্ষক হিসেবে আমরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় যোগদান করে শিক্ষকতা পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছি। শিক্ষকতা পেশার যে সম্মান-মর্যাদা, সেটাকে আমরা বিক্রি করে দিচ্ছি। এর পেছনে দুটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, আমরা শিক্ষকরাও কিছুটা দায়ী আর সরকারের কিছু সিদ্ধান্তও এ ঘটনার জন্য দায়ী। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে বঙ্গবন্ধু শিক্ষার যে মান দাঁড় করিয়েছেন, পরবর্তীতে সেটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। নানা কারণে এসব হচ্ছে।


বিবার্তা : এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় কী?


ড. আরেফিন সিদ্দিক : এটা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং যারা এই পেশায় আসবে তাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে প্রথম শ্রেণীর চাকরির মাধ্যমে শিক্ষকতায় আনতে হবে। তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীরা থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা যে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পায় আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা পায় না। তাহলে তারা শিক্ষকতা পেশায় কেন যেতে চাইবে?


বিবার্তা : শিক্ষক ও সরকারের উদ্দেশ্যে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে কি পরামর্শ দেবেন?


ড. আরেফিন সিদ্দিক : আমরা শিক্ষকরা শিক্ষা দেই, কিন্তু সেই শিক্ষা শিক্ষার্থীরা কতটুকু গ্রহণ করেছে সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি কিনা? এ বিষয়টি শিক্ষকদের মাথায় রাখতে হবে। আর সরকারের উদ্দেশ্যে বলবো, আমাদের শিক্ষকদের এমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত যাতে করে শিক্ষকদের কোচিংসহ অন্য প্রফেশনের সাথে জড়িত হতে না হয়। শিক্ষকের ধ্যান-জ্ঞান যাতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী নিয়ে হয় সে ব্যবস্থা করা উচিত।


বিবার্তা : বিবার্তাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।


ড. আরেফিন সিদ্দিক : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com