২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছুঁয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থাকলেও ২০২৩ সালে এসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন। এদিকে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মহানগরের হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ডিসেম্বরের ৩০ দিনে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছর এডিস মশাবাহিত এ রোগে মারা গেছেন ১ হাজার ৭০৩ জন।
অর্থাৎ গত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, গত এক বছরে তার চেয়ে বেশি মানুষ এই রোগে মারা গেছেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয় ১৯৬০ সালের দিকে। এরপর কেটে গেছে চার দশক। তারপর ২০০০ সালের জুন মাসে ডেঙ্গু সর্বপ্রথম মহামারি আকারে দেখা দেয় বাংলাদেশে। সে বছর মোট ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, যার মাঝে মারা যায় ৯৩ জন।
এরপর কম-বেশি প্রতিবছরই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে। কিন্তু সেই সংখ্যা কখনোই ২০২৩ সালের মতো এত প্রকট আকার ধারণ করে নি।
এই সময়ের মাঝে ২০২৩ সালের আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিলো কোভিডের আগের বছর ২০১৯ সালে। ঐ বছর সারাদেশে মোট ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, মারা যায় ১৬৪ জন।
২০১৯ এর সাথে এ বছরকে তুলনা করলে দেখা যায়, এই সময়ের মাঝে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে দশগুণ। সেইসাথে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়ে হয়েছে তিনগুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের এই পরিণতির পেছনে গত কয়েক বছর ধরে চলমান অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্যখাতের দুরবস্থাসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
অনেক বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মশার ওষুধ ছিটানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মত নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিডকালীন সময়ে মানুষের জীবনযাপন সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে পরবর্তী কয়েক বছর ডেঙ্গু ২০১৯ সালের মতো প্রকট আকার ধারণ করতে করে নি।
স্বাস্থ্য বিভাগের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুমের হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারাদেশে মোট ১ হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও ঐ বছর মারা গিয়েছিলো সাত জন।
একটা সময় ধারণা করা হতো, বর্ষাকাল মানেই হলো ডেঙ্গুর মরসুম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সেই বিশ্বাস পাল্টাবার সময় এসেছে। কারণ এখন শুধু বর্ষা না, শীত-গ্রীষ্মেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষা পরবর্তী সময় অর্থাৎ অগাস্ট থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর 'পিক সিজন' বলা হয়।
কিন্তু এ বছর অক্টোবরের পর সংখ্যার বিচারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমে এলেও এখনো তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই ডিসেম্বরেও প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছে।
বিগত পাঁচ বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২২, এই সময়ের মাঝে শুধুমাত্র ডিসেম্বর মাসে মোট মারা গেছে ৩৪ জন। কিন্তু এ বছর এই মাসে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৭৬ জন, যা গত ৫ বছরের ডিসেম্বর মাসের মোট মৃত্যুর চেয়ে দুই গুণ বেশি।
"ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ আসলে জলবায়ুর উষ্ণতা। তাপমাত্রা যদি ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে চলে যায়, তাহলে মশার ডিম থেকে লার্ভা বের হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এবার শীতের সময় ১৩ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা নামছে না। পঞ্চগড়, দিনাজপুরের দিকে হয়তো নামছে; কিন্তু সারাদেশে না।"
এমনটাই বলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
একই ধরনের অভিমত কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় নদী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীরও।
তিনি বলেন, "এ বছর ব্যাপক ডেঙ্গুর ব্যাপকতার কারণ, আবহাওয়া মশার পক্ষে ছিলো সারাবছর। একটা লম্বা সময়ের জন্য উচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ছিলো। সেইসাথে, থেমে থেমে বৃষ্টি ছিলো।"
"এবার শীতের সময় যেসব এলাকায় ডেঙ্গু পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকার তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি। যেমন, পুরান ঢাকা। ওখানে এডিস মশা ব্রিড করতে পারে। কারণ মশার ব্রিডিং-এর জন্য নূন্যতম তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেই হয়। রমনা পার্কে কিন্তু এডিস মশার প্রজনন নাই এখন, কারণ অনেক গাছপালা হওয়ায় ওখানে খুব ঠাণ্ডা।"
সাধারণত ঢাকা সবসময় ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকলেও এবার গ্রামাঞ্চলেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এবছর ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু পাওয়ার কারণ হল গ্রামের 'সেমি-আরবান কন্ডিশন'।
অর্থাৎ আগে নগরায়নের ছোঁয়া শুধু শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু বিগত এক দশকে ঢাকার বাইরের অবকাঠামোগত চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
ড. মুশতাক বলেন, "যত নগরায়ন বাড়ছে, তত অপরিচ্ছন্নতা বাড়ছে। এ কারণে যেখানে-সেখানে পরিষ্কার পানি জমে থাকছে, যা এডিস মশার প্রজনন কেন্দ্র। অথচ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান শর্তই হল পরিচ্ছন্নতা।"
তাছাড়া, গ্রামাঞ্চলে গত বছর থেকেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। কিন্তু এবার সেটা প্রকট আকার ধারণ করার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "আগে যারা একটা সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে, এবার তারা অন্য একটা দিয়ে হয়েছে। ফলে গ্রামে সিরিয়াস রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে এবার।"
বলা হয়, কোনও ভূখণ্ডে যদি একবার ডেঙ্গু দেখা দেয়, তবে সেটিকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করার কোনও উপায় নেই; বড়জোর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর, নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন।
এই দুই সমস্যা মেটানোয় সরকার যদি যথাযথ ব্যবস্থা এখন থেকেই গ্রহণ না করে, তাহলে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেন আইইডিসিআরের ড. মুশতাক।
"আগামীবার গ্রামে ক্যাজুয়ালিটি আরও বেশি হবে, কারণ সেখানে এডিস মশার চাষবাস হচ্ছে। তাছাড়া, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মশা নিধন করার সক্ষমতা নাই । তাদের সেই অভিজ্ঞতা, সম্পদ, লোকবল, কোনোটা নাই।"
এ বছর অগাস্ট থেকে অক্টোবরে ঢাকাসহ দেশের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বড় হাসপাতালগুলোতে এমন অবস্থা হয়েছিলো যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলো। মেঝেতেও জায়গা দিতে পারছিলো না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করে, যদি উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে জটিল রোগীকে (বাচ্চা, গর্ভবতী নারী বা বয়স্ক মানুষ) পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা না থাকে, হাসপাতাল যদি ওয়েল-ইকুইপড না হয়, যদি সেখানে ডাক্তার এবং নার্স না থাকে; তাহলে রোগীরা ঢাকামুখী হবেই।
সেক্ষেত্রে ঢাকায় আসতে আসতে রোগীর শরীরের আরও অবনতি হবে এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়বে।
দীর্ঘ দুই দশক পর প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাত বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 'জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র'-এর খসড়ায় (২০২৪-২০৩০) বলা হয়েছে, এই ৭ বছরের মাঝে প্রতি লাখে ডেঙ্গু সংক্রমণ ১০০-তে এবং মৃত্যুহার ০.১ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনা হবে।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]