শিরোনাম
'কাজের লোকের' গল্প
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০১৮, ১৮:৩৯
'কাজের লোকের' গল্প
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

একেবারে ছোটবেলার কথা। বাসায় একাধিক কাজের লোক ছিলেন৷। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বাবাকে প্রায়ই যেতে হতো বাড়ির বাইরে বহুদূর। ছয় ভাইবোনের বিরাট সংসার সামলাতে তখন মা'কে সাহায্য করতে আসতেন তাঁরা।


একজন আয়ার দায়িত্ব ছিল আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড় ভাইয়ের দেখাশোনা করা। তাঁকে আমরা ‘আইয়া' বলে ডাকতাম। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি যখন চলে যান তখন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। আমি বলতাম, ‘‘আইয়ার জন্য পরান পুড়ে।''


এরপর অনেক কাজের লোক এসেছেন আমাদের বাসায়। তাঁদের সবার মধ্যে একটা বিষয় খুব কমন ছিল। তা হলো, তাঁরা সবাই আমার মা'কে খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেও বারবার এসেছেন মায়ের কাছে। এমনকি আমার মা মারা যাবার পরও অনেকে এখনো আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার মায়ের জন্য তাঁরা মন খারাপ করেন।


শ্রেণীবৈষম্য থাকলেও এভাবেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্ক দেনা-পাওনার বাইরেও অন্য এক সম্পর্ক। সেখানে নানান আবেগ কাজ করে।


আসলে বাড়িতে যখন কোনো কাজের লোক অনেকদিন থাকেন, তখন অজান্তেই তাঁরাও পরিবারের সদস্য হয়ে যান। অনেকের হয়তো ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে অভিজ্ঞতা কম-বেশি অনেকটা এমনই ছিল। এমনকি যেসব নারীর শিশুসন্তান ছিল, তাঁরা সেই সন্তানকেও নিয়ে আসতেন। সেই শিশুরাও আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যেতো।


অনেক মজার স্মৃতিও থাকে এদেরকে নিয়ে। একটা ঘটনা বলি। স্কুলের পর ঢাকায় পড়াশুনা করতে আসি। থাকি বোনের বাসায়। সেখানেও এক বুয়া বহু বছর ধরে কাজ করতেন। তাঁকেও দেখেছি ঠিক বাড়ির লোকদের মতোই আচরণ করতে। সেই বুয়া ছিলেন চিত্রনায়ক মান্নার বিরাট ভক্ত।


একবার হলো কি, চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে দেখি মান্না অভিনীত কোনো এক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে কোনো এক চ্যানেলে। আমি চ্যানেলের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুয়া হাজির দরজার সামনে। স্ক্রিনে তখন মান্নার ফাইটিং দৃশ্য। মান্না তাঁর দিগ্বিজয়ী অ্যাকশনে ঘায়েল করছেন সব শত্রুকে। কিছুক্ষণ পর দেখি বুয়া নিচু কণ্ঠে বলছেন, ‘‘মার, মার অরে!'' তাকিয়ে দেখি, তিনি খুব সিরিয়াস। আর আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি।


বহুবার এমন হয়েছে, বুয়া তাঁর বাড়িতে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য। তাঁর এই যে বাড়তি ভালোবাসা, তা কোনোভাবেই মাস গেলে বেতন দিয়ে মাপা সম্ভব নয়।


আমি বলছি না, সবার অভিজ্ঞতা এক হবে। কিন্তু এই কাজের লোকগুলোই অনেক সময় পরিবারের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এমন অনেক সময় হয়েছে যে, বাড়ি তাঁদের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে যেতে হয়েছে। আমার পরিবারের অভিজ্ঞতা হলো, তাঁরা খুব ভালোভাবেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন।


তবে অনেকেরই কাজের লোক নিয়ে বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এছাড়া এখন সময় বদলেছে। কাজের লোকের চাহিদা বেড়েছে, বেড়েছে তাঁদের ব্যস্ততা। এখন সবাই খুব পেশাদার। তাই কাজের লোকদের সঙ্গে সেই যে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ, তা-ও সংকুচিত হয়ে গেছে। তবে পুরোপুরি পেশাদার হওয়াও ভালো।


আমাদের সমাজে বাড়ির লোকদের কাজকে ‘কাজ' হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না, তাই কাজের বুয়াদের কাজকেও শ্রমের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় না। যে যার যার মতো করে বেতন দেন। শুধু মাস শেষে বেতন আর উৎসবে কিছু উপরি - এর বাইরে বুয়াদের শ্রমের কোনো কাঠামো না থাকার ফলে কাজের প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই।


যোবায়ের আহমেদের ব্লগ থেকে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com