শিরোনাম
টেবিলে মৃত্যু, সেই নারী ব্যাংকারের করুণ গল্প
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০১৯, ১০:১৩
টেবিলে মৃত্যু, সেই নারী ব্যাংকারের করুণ গল্প
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

অফিসে কাজের মধ্যেই টেবিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রাইম ব্যাংক উত্তরা শাখার কর্মকর্তা গহর জাহান। তার মৃত্যুতে মর্মাহত হন হাজারো মানুষ। অনেকে তার মৃত্যুর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করেন। তাকে নিয়ে অনেকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন।


তবে ক’জন মানুষ জানেন তার জীবনের মহানুভবতা ও করুণ গল্প?


গহর জাহানের বেঁচে থাকা, লেখাপড়া এবং ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত করুণ। জীবনে সংসার করেননি তিনি। ছিল না স্বামী কিংবা সন্তান। কারণ ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল আগে। ১৯৯৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে ওপেন হার্ট সার্জারি হয় তার। তারপর সেখান থেকেই বোটানিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।


২০০০ সালে প্রাইম ব্যাংকে চাকরি নেন তিনি। ছিলেন রূপে-গুণে অনন্যা। কিন্তু ওপেন হার্ট সার্জারির কথা জেনে বহুবার পাত্রপক্ষ পিছিয়ে যায়। এক সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নেন এই লড়াকু নারী। কখনো বিয়ে করবেন না। নিজের সংসার-সন্তান হয়নি তাতে কী! সন্তানের মতো করে ছোট ভাইবোনদের মাতৃস্নেহে পরম মমতায় বড় করেছেন। আগলে রেখেছেন ভাইয়ের সন্তানদের। যুক্ত হয়েছেন সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।


তার সহায়তায় একাধিক এতিম ছাত্র কোরআনে হাফেজ হয়েছেন। বোনের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছোট ভাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মারুফ নাওয়াজ।


তিনি বলেন, বড় দুঃখী মেয়ে ছিল সে। পুরো জীবনটাই মানুষের সেবায় উৎসর্গ করে গেছে। যার যায় সে বোঝে, হারানোর কী যন্ত্রণা। সে শুধু আমাদের বোন ছিলেনা।ছিলআমার ছোট দুই সন্তান ও ভাইদের মায়ের মতো। ৫ ভাই তিন বোনের মধ্যে বোনদের সবার ছোট ছিলগহর। তার কাছে কেউ আর্থিক সাহায্য চাইতে এসে খালি হাতে ফেরত যাননি। প্রয়োজনে ধারদেনা করে মানুষকে সাহায্য করেছে। তার নিজস্ব সঞ্চিত কোনো অর্থ ছিল না।


মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে ইন্ডিয়ায় যে চিকিৎসকের কাছে ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেতিনি গহরকে অনেক অনুরোধ করেন যেন একবার অন্তত চেকআপ করান। ডাক্তার তাকে মা বলে সম্বোধন করতেন। ছোট ভাই দুবাই থেকে টাকা পাঠিয়ে চেকআপ করতে যেতে অনেক অনুরোধ করেছে। আমি ইতোমধ্যে তার পাসপোর্ট জমা দিয়েছি ভিসার জন্য। এরপর তো সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা মৃত মাওলানা নাওয়াজ ছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম বার্ধক্যের ভারে অনেকটা ন্যুয়ে পড়েছেন।


মারুফ নাওয়াজ বলেন, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখনো উন্নত হয়নি। তার বিয়ের অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু সার্জারির বিষয়টি আমরা কোনোভাবে লুকাইনি। আমরা খুব সহজে পাত্রপক্ষকে এটা জানালে পরবর্তীতে তারা আর বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।


তিনি বলেন, গহর ছিল আমার ইমিডিয়েট এক বছরের বড়। ওকে আমরা প্রায়ই বলতাম তুমি বিয়ে করো। তখন সে বলতো, ‘না ভাই। ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য হয় তো অনেকে আমাকে পছন্দ করে না।’ আমার বোন দেখতে অনেক গুড লুকিং এবং সুশ্রী ছিল। অনেকটা অভিমান নিয়ে বলতো, বাকিটা জীবন আমি তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই।


সে নিজেকে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছিল। রোটারি ক্লাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাবের সদস্য ছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় দান খয়রাত করত। নিজ খরচে একাধিক এতিম ছেলেকে হাফেজ তৈরি করেছে। দুস্থদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অফিসের সহকর্মীদের কাছেও সে ছিল প্রিয় মুখ। তার জানাজায় সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।


মারুফ নাওয়াজ জানান, দিনে-রাতে যে কারো কোনো বিপদে ছুটে যেত গহর। বলতেন, মাদার তেরেসা যেভাবে নিজের জীবন মানব সেবায় ব্যয় করেছে আমিও সেভাবে মানবতার সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করতে চাই। বোন হিসেবে সে ছিল অসাধারণ। অনেকটা মায়ের মতো। আমার ছোট দুই ভাইকে পড়ালেখা থেকে শুরু করে বিদেশে পাঠানো সবকিছুই আমার এই বোন করেছে। মা আমাদের জন্ম দিলেও ছোট ভাই-বোনদের প্রতি সে এত যত্নশীল এবং কেয়ারিং ছিল যেটা বলে বোঝানো যাবে না। সে উত্তরাতে আমাদের সঙ্গে থাকত।


আমার ছোট দুই ছেলেকে আব্বাজান বলে ডাকত। এমনকি আমার বিয়ের কনে দেখা থেকে শুরু করে সবকিছুই করেছে সে। আমার বাচ্চাদের ছবি তার কর্মস্থলে ঝুলিয়ে রাখত। ব্যাংকের গ্রাহকরা জানতে চাইলে বলতেন, এরা আমার বাচ্চা। গহরের বয়স হয়েছিল ৪৪ বছর। বোনের ফিরতে একটু দেরি হলে ফোন দিয়ে বলতাম, তোমার এত দেরি হচ্ছে কেন। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।


মারুফ নাওয়াজ আরো জানান, ঘটনার দিন সকালে আমার স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে নাস্তা করে গহর। এ সময় সে বলে, ‘আমার বাচ্চারা কই। আজ আমার মিটিং আছে একটু আগে যেতে হবে। তোমরা ভালো থেক’। এটাই ছিল আমাদের সঙ্গে তার শেষ কথা।


প্রত্যেক মেয়ের স্বপ্ন থাকে নিজের একটি ছোট্ট সুন্দর সংসার হবে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ছেলেটা আজও জন্মাল না, যে আমার বোনের শারীরিক এই তুচ্ছ দুর্ঘটনাকে আপন করে নেবে। এটা শুধু আমার নয় আমার পুরো পরিবারের দুঃখ। গহর আমাদের বলে গেছে, ‘আমি যেসব সমাজসেবামূলক কাজ করতাম, এগুলো তোমরা নিয়মিত করবে।’


গত সোমবার (২৬ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গহর জাহান। কাজ করার মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছে, ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।


তার মৃত্যুর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুপুরে ওই নারী কর্মকর্তার ডেস্কে একজন নারী গ্রাহক আসেন। ওই নারী গ্রাহকের কাছ থেকে একটি কাগজ নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলেন গহর জাহান। এ সময় তিনবার পানি পান করেন তিনি। এ ছাড়া একাধিকবার গালে, নাকে-মুখে, চোখে হাত দিতে দেখা যায়। হঠাৎ করেই টেবিলে মাথা রেখে নুইয়ে পড়েন তিনি।


পরে তাকে ধরে চেয়ারে বসানোর চেষ্টা করেন সহকর্মীরা। তবে তিনি চেয়ার থেকে ফ্লোরে পরে যান। কিছুক্ষণ তার সেবা করে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালের নিয়ে যান।


প্রাইম ব্যাংকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (জনসংযোগ) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা খুবই শোকাহত। কাজ করা অবস্থায় একজন সহকর্মীর মৃত্যু আমাদের ব্যাংকের সবাইকে মর্মাহত করেছে।


গহর জাহানের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী শহরের মহিষবাথান এলাকায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে লেখাপড়া করে ২০০১ সালে চাকরিতে যোগ দেন তিনি।


বিবার্তা/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com