শিরোনাম
টাঙ্গাইলে হাটে চামড়া আছে, ক্রেতা নেই
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ২২:১১
টাঙ্গাইলে হাটে চামড়া আছে, ক্রেতা নেই
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর টাঙ্গাইলের পাকুটিয়ার চামড়ার হাটে ধস নেমেছে।ফড়িয়ারা যে দামে মফস্বল থেকে চামড়া কিনেছেন তার অর্ধেক দামেও বিক্রি করতে না পেরে হতাস হয়ে পড়েছেন।


জানাগেছে, ১৯৮১ সালে মূলত: ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়ায় চামড়ার হাটের যাত্রা শুরু হয়।চামড়া শিল্পকে ঘিরে সপ্তাহের প্রতি রবিবার ও বুধবার চামড়ার হাট বসে। হাট বসানোয় টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা বিশেষ ভূমিকা রাখেন।


মধুপুর, গোপালপুর ও ঘাটাইল উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে হাটটি গড়ে ওঠায় দেশের চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে ‘পাকুটিয়া চামড়ার হাট’ বিশেষ পরিচিতি লাভ করে।


বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর সহ ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা থেকে চামড়া বেচা-কেনা করতে ব্যবসায়ীরা এই হাটে আসেন।দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্যানারি মালিক, বিভিন্ন কোম্পানীর এজেণ্ট, বড়-বড় মহাজন, ঋষি, ফড়িয়া সহ মৌসুমী ব্যববসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এ হাট।ঈদুল আজহার সময় আরো বেশি লোকজনের সমাগম ঘটে থাকে।


সরেজমিনে রবিবার (১৮ আগস্ট) ঈদুল আজহা পরবর্তী প্রথম হাটে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অন্য বছর কয়েক লাখ চামড়া আমদানি হলেও এবার ৫০ হাজারেরও কম চামড়া আমদানি হয়েছে। যে পরিমাণ চামড়া হাটে উঠেছে সেগুলোও কেনার মতো ক্রেতা হাটে আসেনি।


টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা, নেত্রকোণা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ থেকে ১০-১২টি কোম্পানীর এজেণ্ট, ছোট-খাটো কয়েকটি ট্যানারির মালিক ও স্থানীয় কয়েকজন ক্রেতা ছাড়া বড় কোনো কোম্পানীর মালিক বা এজেণ্টদের চোখে পড়েনি।


যে কজন ট্যানারি মালিক বা এজেণ্ট হাটে এসেছে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার এ বছর চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক লোন ছাড় করেনি। টাকার অভাবে তারা চামড়া কিনতে পারছেন না। সরকার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। স্থানীয়ভাবে চামড়া কিনতে হবে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা বর্গফুট। ওই দামে ফড়িয়ারা চামড়া বিক্রি করছেনা। চামড়া না কেনার কারণ হিসেবে তারা জানান, হাট থেকে চামড়া কিনে প্রত্যেকটি চামড়া প্রতি আরো অতিরিক্ত ২০০ টাকা খরচ হবে। এরমধ্যে ট্রান্সপোর্ট, লবণ, শ্রমিক সহ অন্যান্য খরচও যুক্ত হবে। ফলে হাট থেকে কেনা চামড়ার দাম ঢাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি পড়বে।


হাটে আসা ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইউসুফ লেদার কর্পোরেশনের মালিক মো. ইউসুফ হোসেন জানান, তিনি বেছে-বেছে মোটা ও প্রথম শ্রেণির গরুর চামড়া কিনতে এসেছেন। উল্টে-পাল্টে চামড়া দেখছেন ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের সাথে দাম-দর করছেন। জামালপুরের মেলান্দ থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ী জগাই প্রতি চামড়ার দাম হাকছেন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০টাকা। চামড়া দেখা শুনা শেষে ইউসুফ হোসেন দাম বলছেন ৫০০ থেকে ৫৮০ টাকা। বনিবনা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত মফস্বল থেকে সংগ্রহ করা চামড়া জগাই বিক্রি করতে পারেননি।


কালাম ট্যানারির এজেণ্ট আহাম্মদ বাদশা, মঞ্জু ট্যানারির এজেণ্ট দীন ইসলাম, হক ট্রেডার্সের এজেণ্ট মো. সাইদুল হক, মাসুদ ট্যানারির এজেণ্ট ফরিদুজ্জামান, আরকে লেদার কোম্পানির এজেণ্ট মো. মাসুম মিয়া সহ বেশকিছু কোম্পানির এজেণ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা যে মাত্রায় দাম হাকছেন তাতে চামড়া কেনা সম্ভব নয়। তাদের বাজেটের চেয়েও দুই-তিনগুণ বেশি দাম হাকছেন ফড়িয়ারা।


এদিকে ফড়িয়া, খুচরা ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা জানান, তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বা স্থানীয়ভাবে চামড়া সংগ্রহ করে প্রতিপিস চামড়ার পেছনে চামড়া ঝিলানো, লবণ, ট্রান্সপোর্ট, শ্রমিক ও নিজের পারিশ্রমিক ব্যয় হয়েছে। প্রতিপিস চামড়া বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হয়েছে অর্থাৎ পর্তা পড়েছে গড়ে ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০টাকা। সেখানে মহাজন ও ট্যানারি মালিক ও এজেণ্টরা দাম বলছেন ৫০০ টাকা থেকে ৬৮০ টাকা। অনেকেই ২০০ থেকে ৬০০পিস করে চামড়া নিয়ে হাটে এসেছেন। প্রতিপিস চামড়ায় লাভের পরিবর্তে ৯০থেকে ২২০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এমন আকাশ-পাতাল তফাৎ হলে চামড়া বিক্রি করা সম্ভব নয়।


তারা জানান, এ ব্যবসায় সারাবছর উপার্জন করা সম্ভব হয়না। বুকভরা আশা নিয়ে ঈদুল আজহার দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এ হাটে চামড়া বিক্রি করে কিছুটা লাভ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার আশায়। এ বছর লাভ তো দূরের কথা চামড়া এবার তাদের পথে বসাবে। তাদের অনেকে মানুষের কাছে ধার-দেনা করে বা সুদে টাকা নিয়ে চামড়া কিনেছেন। এখন চামড়ায় যে ক্ষতি হচ্ছে- তাতে এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে। সুদ ও ধার করা টাকা পরিশোধ করতে না পারলে গলায় রশি দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের।


অপরদিকে পাকুটিয়ার চামড়ার হাটটি কয়েকজন মিলে ইজারা নিয়ে থাকেন। হাটের ইজারাদার হুমায়ুন ও রফিক জানান, চামড়ার বাজারে ধস নামায় তারাও বিপাকে পড়েছেন। চাহিদা মতো চামড়া আমদানি ও বেঁচা-কেনা না হওয়ায় তাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। তাদের অভিযোগ, চড়া মূল্য দিয়ে হাট ইজারা নিতে হয়েছে। পক্ষান্তরে দিন-দিন মানুষ চামড়া ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে ভবিষ্যতে পাট শিল্পের মতোই চামড়া শিল্পও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।


ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলের পাকুটিয়ার হাটেও চামড়ার দামে প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে সরকার চামড়া শিল্পকে রক্ষার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেহেতু ঈদের পর আজই প্রথম হাট বসেছে তাই পুরো বিষয়টি নিয়ে হাট মালিক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।


বিবার্তা/মোল্লা তোফাজ্জল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com