শিরোনাম
সফল উদ্যোক্তা আতিকুরের জীবন সংগ্রাম
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০১৯, ১৮:০১
সফল উদ্যোক্তা আতিকুরের জীবন সংগ্রাম
জয়পুরহাট প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

উচ্চ শিক্ষার পরেও চাকরি না হওয়ায় যখন হতাশা গ্রাস করে তখন যুব উন্নয়ন অধিদফতরের গবাদি পশু পালন প্রশিক্ষণ আতিকুর রহমানের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।


মাত্র সাড়ে চার বছরে মেধা আর পরিশ্রমের ফসল হিসাবে জেলা পর্যায়ে সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতি লাভ করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই যুবক।


জেলার কালাই উপজেলার জিন্দারপুর ইউনিয়নের বাদাউস গ্রামের কৃষক আতাউর রহমানের ছেলে আতিকুর রহমান। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে বিএসসি ইন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিলেও চাকরি না হওয়ায় সমাজ ও পরিবারে নিজেকে অযোগ্য মনে হতো আতিকুরের।


আতিকুর রহমান বলেন, মনের মাঝে সব সময় এই চিন্তার উদয় হত বাবা বৃদ্ধ কৃষক, মা গৃহিনী, ছোট বোনের সকল দায়িত্ব নিতে হবে, বিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হত যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব।এরই মাঝে একদিন আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার সেই ডায়লগ ‘যদি একটি বানরের সামনে একটি কলা ও একশ ডলার ফেলে দেয়া হয় তাহলে বানর কলাটিকেই নিবে, কারণ বানর জানে না একশ ডলার দিয়ে আরো অনেকগুলো কলা কিনা যায়।’


জ্যাক মার এ কথা তার জীবনে সাহস যোগায়। সে প্রতিজ্ঞা করে আমি ব্যবসা করব, চাকরি না করে মানুষকে চাকরি দেব।


একদিন তিনি যুব উন্নয়ন অফিসে গিয়ে উপপরিচালক তোছাদ্দেক হোসেনের সাথে সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন। তার উৎসাহে পরে কালাই উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা রওশন আলমের সাথে দেখা করেন এবং যুব উন্নয়ন অধিদফতরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হন।


পরে কালাই উপজেলা হতে সাতদিন মেয়াদি ‘গবাদি পশু পালনের’ প্রশিক্ষন গ্রহণ করে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার পরামর্শে যুব উন্নয়ন তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরুর খামার শুরু করেন।


চারটি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু। কিছুদিন পর কিছু লাভ। শুরু হয় সাহস নিয়ে এগিয়ে চলা। পরবর্তীতে হাস-মুরগির ট্রেনিং নিয়ে এলাকায় ফেন্সি জাতের টার্কি, তিতির, কেদারনাথ ও কোয়েল পাখির চাষে এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।


এরপর যুব উন্নয়ন অধিদফতর জয়পুরহাট হতে তিন মাস মেয়াদী গবাদি পশু, হাসমুরগি পালন, মৎস চাষ, প্রাথমিক চিকিৎসা, কৃষি সহ ছয়টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ নেন। অদম্য সাহসী আতিকুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল উপজেলার পাঠানপাড়া এলাকায় এবং কালাই উপজেলার করিমপুর এলাকায় ঘর ভাড়া করে শুরু করেন খামার।


পরবর্তিতে ব্যাংক হতে কিছু ঋণ ও লাভের টাকা দিয়ে মাছ চাষে আত্মনিয়োগ করেন। গড়ে তুলেন ‘তাহেরা মজিদ মাল্টিপারপাস এগ্রো ইন্ডাঃ লিঃ’ নামে একটি সমন্বিত ফার্ম। এর অধীন রয়েছে আরো তিনটি প্রতিষ্ঠান ‘মন্ডল হ্যাচারি এন্ড চিকস্’, ‘মেসার্স আদি ট্রেডার্স’ ও ‘মেসার্স মন্ডল ট্রেডার্স’। এছাড়াও ‘সায়ান ফার্মেসী’ নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যার স্বত্ত্বাধিকারী স্ত্রী শিউলী খাতুন।


সব মিলিয়ে আতিকুরের খামারে এখন ৪৫ জন স্থায়ী এবং ৩৫ জন অস্থায়ী কর্মচারী কাজ করেন। খামারে ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন নুর ইসলাম ও রায়হান আহমেদ নামে দুই যুবক। তাদের মত অনেক বেকার যুবক এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।


আতিকুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০০ খামারি। ইটাইল গ্রামের মুক্তার হোসেন ও কয়তাহার গ্রামের সাইদুল কাজী তাদের অন্যতম। যুব উন্নয়ন অধিদফতরের উপপরিচালক তোছাদ্দেক হোসেনের মতে খামারি সৃষ্টি করে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন আতিকুর রহমান।


বর্তমানে আতিকুর রহমানের ফার্মে প্রায় এক লাখ সোনালী মাংসের মুরগি, ১০ হাজার সোনালী ডিমের মুরগি, ৫০ হাজার ব্রয়লার মুরগি, ৬টি পুকুর যাতে প্রায় ১ হাজার মণ রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া মাছ রয়েছে।


প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পিকআপের মাধ্যমে সোনারী মুরগি ঢাকা সহ চাপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন আড়তে মাছ সরবারহ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে আতিকুরের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা হলেও পুঁজি সহ নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা। সব খরচ বাদেও ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা মাসিক আয় থাকছে বলে জানান আতিকুর। এসবের মাধ্যমে সাড়ে ৪ বছরে মেধা আর শ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে সফল আত্মকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন আতিকুর রহমান। ইতোমধ্যে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে জাতীয় যুব দিবস-২০১৮ তে জেলা পর্যায়ে “শ্রেষ্ঠ সফল আত্মকর্মী ও উদ্যোক্তা” হিসেবে ক্রেস্ট ও সম্মাননা লাভ করেছেন আতিকুর।


শেখ হাসিনা যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ঢাকাতে গত ১৯ জুন অনুষ্ঠিত ৫ দিনের ‘যুব বিনিময়’ কর্মসূচিতে জয়পুরহাটের সফল আত্মকর্মী হিসেবে প্রতিনিধিত্বও করেন। ‘যুবরাই লড়বে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়বে’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে সরকারের ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে যুবরাই এগিয়ে আসবে এ প্রত্যাশা করেন আতিকুর রহমান।


সফল উদ্যোক্তা হিসাবে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েও কাজ করেন আতিকুর। এলাকায় দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, রক্তদান, বৃক্ষ রোপণ, নারী ও শিশুর অধিকার ও জঙ্গিবাদ ও মাদকবিরোধী কাজেও সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন তিনি।


বিবার্তা/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com