পুরোনো ঐতিহ্য হাতে ভাজা মুড়ির কারিগর অর্চনা দাস
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫, ০০:০১
পুরোনো ঐতিহ্য হাতে ভাজা মুড়ির কারিগর অর্চনা দাস
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৌরশহরের পাইকপাড়া মহল্লার অলিগলি কয়েকটি বাঁকা পথ হাঁটতে হাঁটতে তিতাস নদীর পাড় পর্যন্ত যেতেই মট-মট শব্দ আর বাতাসে ভেসে আসছে সুঘ্রাণ। একটু যেতেই বুঝা গেল মুড়ি ভাজার শব্দ। কয়েকজন নারী সংসার নিয়ে কথা বলছে আর পুরাতন পদ্ধতিতে গরম বালুর স্পর্শে তা মট-মট শব্দে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি।


মুড়ি ভাজার স্থানের কাছে যেতেই একজন নারী বললেন, বাবু মুড়ি লাগবে। কত কেজি দিব বলেন। কেজির দাম জানতে চাইলে হেঁসে দিয়ে বললেন একটা আছে একশত টাকা আর ভালোটা নিতে চাইলে একশত বিশ টাকা।


বাবু ডাকে সম্মোধন করা সেই নারীই হলেন হাতে ভাজা মুড়ির মূল কারিগর অর্চনা দাস (৫৫)। অর্চনা দাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের পাইকপাড়া পাটগুদাম রোড দাস পাড়ার ঝান্টু দাসের স্ত্রী। ঝান্টু দাস পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ি। অর্চনা দাসের চার মেয়ে ও এক ছেলে। চার মেয়েকেই দিয়ে দিয়েছেন বিয়ে এবং ছেলে এই বছর পড়াশোনা করে বিবিএ শেষ করেছে।


অর্চনা দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই শাশুড়ী তরঙ্গ বালা দাস হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতেন। আমি এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর আমার শাশুড়ি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। শাশুড়ির কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমিও মুড়ি ভাজা শিখে ফেলি। শাশুড়ি ২০১৯ সালে মারা গেলে ছেলেমেয়েরা মুড়ি ভাজতে নিষেধ দিয়েছিল। কিন্তু শাশুড়ীর ৫০ বছরের পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই মুড়ি ভাজার দায়িত্বটা আমি আমার কাঁধে নিয়ে নেই।


মুড়ি ভাজতে উপকরণ হিসেবে তিনি জানান, হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতে দেশি চাউল দিয়েও হয় তবে রমজান আসলে মুড়িগুলো সুন্দর হতে ভারতীয় "শান্তি সিলভার" নামে এক কোম্পানির চাউল আছে সেটা ব্যবহার করি। চালগুলো প্রথমে লবণ পানি দিয়ে মেখে দেয় আমার ভাইয়ের মেয়ে সুলেখা দাস। লবণ পানি দেওয়া চালগুলো তাওয়াতে (করাই) ৪-৫ মিনিট গরম করে তারপর আমার ভাসুরের ছেলের বউ বন্দনা দাস গরম বালুতে সেই চাউলগুলো ঢেলে চিকন কাঠি দিয়ে হাতে নাড়া দিলেই হয়ে যাচ্ছে মট- মট শব্দে হাতে ভাজা মুড়ি।


অর্চনা দাস বলেন, আমার শাশুড়ির বাড়িতে এসে আমি দেখেছি ১৯৯০ সালে এক কেজি মুড়ি ২৪ টাকা ধরে বিক্রি করতেন। এখন বাড়িতে মুড়ি বিক্রি করি ১২০ টাকা ধরে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এক বস্তা চালের দাম ৩৪০০ টাকা, লবণ লাগে ৩০টাকা, রিকশাভাড়া ৩০, ভাজা খরচ ১৪০, এক বস্তা চাউলে ৩৮ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে এক দিনে ৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি পারি। রমজান মাস ছাড়া ২৫ কেজি বিক্রি হয়।


পাইকার ব্যবসায়িরা এক কেজি মুড়ি ৯৫ টাকা ধরে কিনে নিয়ে যায়। পাইকাররা কেজি প্রতি ১২০ টাকা বিক্রি করেন।


প্রতিবেশি নিদু দাস বলেন, আমরা ২০ বছর ধরে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করতাম। বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে পেশাটাকে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের যা কাষ্টমার ছিল এখন অর্চনা দাস থেকে মুড়ি নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই আসে মুড়ি নিতে। রমজান মাসে এর চাহিদা বেশি থাকে। এখানে আগে ১০টা পরিবারের মতো হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করতেন। কিন্তু বর্তমানে লোকবল সংকটের কারণে এই পেশা থেকে মানুষ দূরে চলে গেছে।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি জাবেদ রহিম বিজন জানান, আমি ১০ বছর ধরে তাদের বাড়ি থেকে মুড়ি কিনি। সুস্বাদু ও ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় আমার পরিবারের পছন্দ এই মুড়ি। দুই কেজি মুড়ি ২৪০ টাকা দিয়ে কিনেছেন বলে তিনি জানান।


কুমারশিল মোড়ের নিউ স্টোরের সত্ত্বাধিকারী হৃদয় রায় বলেন, পাইকপাড়া থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আমরা কিনে রাখি। হাতে ভাজা মুড়ি পুরাতন কাস্টমার যারা আছে তারা কিনে নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। তাই রমজানসহ বারো মাসেই অনেক কাস্টমার এখান থেকে নিয়ে যায়। তবে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা এখন কমে গেছে। কারণ মেশিনের ভাজা মুড়ি এখন বেড়ে যাওয়ায় কাস্টমাররা তাদের পাড়া মহল্লার দোকান থেকেই কিনে ফেলে।


বিবার্তা/আকঞ্জি/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com