
নিজ উপজেলা শহরে নতুন প্রতিষ্ঠিত কলেজ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রফিকুন্নবী চৌধুরী। আশা ছিল কলেজ এমপিও হবে, বেতন পাবেন। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করবেন। তবে দীর্ঘ ২০ বছর বিনাবেতনে শিক্ষকতা করার পর অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে হয়নি বেতন।
এমনি ঘটনা ঘটেছে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা শহরে অবস্থিত আইডিয়াল গার্লস কলেজে। রফিকুন্নবী চৌধুরীর মত এই প্রতিষ্ঠানের আরও দুই শিক্ষকের অভিযোগ, অধ্যক্ষের কারণে তাদের পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
জানা যায়, আইডিয়াল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। কলেজটি এমপিও হয় ২০২২ সালে। বর্তমানে কলেজের ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৩০০ জন। শিক্ষক রয়েছেন ২১ জন। বেতন না হওয়া তিনজন শিক্ষক হলেন- ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক রফিকুন্নবী চৌধুরী, অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভূগোল বিষয়ের প্রভাষক তপন কুমার বিশ্বাস ও আইসিটি বিষয়ের প্রভাষক সিদ্ধিরাম ঘোষ।
রফিকুন্নবী চৌধুরী কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্বশ্বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে ২০০৪ সালে কলেজটিতে যোগদান করেন। কলেজটির রফিকুন্নবী চৌধুরী ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক ছিলেন। তপন কুমার বিশ্বাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে অনার্স মাস্টার্স পাশ করেছেন প্রথম শ্রেণিতে। ২০০৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে চাকরি করছিলেন। ২০২২ সালে কলেজ এমপিও হলেও তার এমপিও হয়নি। সিদ্ধিরাম ঘোষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে ১৯৯৯ সালে ৩৪ বছর বয়সে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে যোগ দেন। আইসিটি বিষয়ে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারে এমএ ও কারিগরি থেকে ডিপ্লোমা করেন তিনি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত কলেজটির আইসিটি বিষয়ে চাকরি করলেও এমপিও করা হয়নি।
রফিকুন্নবী চৌধুরী জানান, ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি তিনি পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রয়াত আব্দুল ওহাব নিয়োগ দেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনা বেতনে চাকরি করেন। করোনার কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করেন। তবে ২০২২ সালের ১৬ জুলাই কলেজে গেলে অধ্যক্ষ তাকে কলেজে আসতে নিষেধ করেন। কলেজ থেকে কোনো অব্যাহতি পত্র ছাড়াই তাকে অধ্যক্ষ বাদ দিয়ে দেন। উপায় না পেয়ে ২০২২ সালের ২৫ জুলাই পাংশা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন বেতন ভাতার দাবি ও চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য। মামলাটি এখনও চলমান। এর মধ্যে তথ্য গোপন করে স্বর্ণালী খাতুন নামে একজনকে ইংরেজি শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়ে বেতন করিয়েছেন অধ্যক্ষ বলে জানান তিনি। যদিও একজন পদে থাকতে আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান নেই বলে দাবি তার।
তিনি বলেন, এমপিও হবে এ আশায় ২০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের উপর নির্ভরশীল থেকেছেন। আয়-রোজগার না থাকায় বিয়েটাই করতে পারেননি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন। বাড়ির গাছপালা বিক্রি করে এবং জমি লিজ দিয়ে কোনোমতে চলছেন। অধ্যক্ষের কারণে তার পুরো জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
পাংশা কলেজ পাড়ার বাসিন্দা তপন কুমার বিশ্বাস জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজে যোগদান করেছি। গত ২০ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে এখন আমার এমপিওতে দেখানো হয়েছে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতার অভাব। তিনি কমার্সের ছাত্র হিসেবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন।
তিনি বলেন, অধ্যক্ষ নিজের পছন্দমতো লোক নিয়োগ করেন। তার কারসাজির কারণেই এমপিও হয়নি। ছাত্রাবস্থায় হোমিও পড়েছিলেন। এখন নিজ বাসাতেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে সংসার চালান। পরিবারে স্ত্রী আর দুই ছেলে রয়েছে।
বঞ্চিত আরও এক শিক্ষক সিদ্ধিরাম ঘোষ জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাংশা আইয়িাল গার্লস কলেজে চাকরি করেছেন আইসিটি বিষয়ে। তার শ্বশুর পরিমল কুমার দের অনুদানের টাকায় কলেজের একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে তার শাশুড়ির নামে নামকরণ করা হয়েছে ভবনটির। অধ্যক্ষ তার বিপক্ষে কাজ করে এমপিও করেননি। অথচ তাকে বলা হয় তার সার্টিফিকেট জাল। জানা যায়, পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজের একমাত্র মাস্টার্স ট্রেইনার ছিলেন সিদ্ধিরাম ঘোষ। সেটা কীভাবে বোর্ড নিয়োগ দিল প্রশ্ন তার। তার স্ত্রী একটি কলেজে চাকরি করতেন। স্ত্রীর আয়েই চলেছে সংসার। এক ছেলে, এক মেয়েকে পড়াশোনা করাতে হয়েছে অনেক কষ্ট।
এ বিষয়ে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নানের মুঠোফোনে কথা হলে তিনি সাক্ষাৎ ছাড়া কিছু বলতে রাজি হননি। কি কারণে সাক্ষাৎ করে জানতে হবে বললে তিনি জানান, এখানে অনেক কাগজ-পাতির ব্যাপার, না দেখালে আপনি বুঝবেন না!
কলেজের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি ও পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আবু দারদা বলেন, বঞ্চিত শিক্ষকদের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। লিখিত জানানো হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিবার্তা/মিঠুন/এনএইচ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]