ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমেছে গোষ্ঠীগত সংঘাত
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১৬:১১
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমেছে গোষ্ঠীগত সংঘাত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে সংঘাতপীড়িত এক জনপদের প্রামাণ্যচিত্র। যেখানে প্রায়শই দেখা যায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে রক্তক্ষয়ী ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব।


দু বছর ধরে পুলিশের কৌশলী নানা পদক্ষেপে অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব গ্রাম্য দাঙ্গা। যার কুফল সম্পর্কে সচেতন হয়ে শান্তির পথে ফিরে আসছেন স্থানীয়রা।


২০১১ সালে মাত্র চার আনা ওজনের একটি কানের দুল চুরির ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ধামাউড়া গ্রামের গাজী গোষ্ঠী ও বারী গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৬ বছর চলা এ বিরোধের জেরে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন নিহত হন, আহত হন শতাধিক।


এছাড়া আশুগঞ্জ, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর উপজেলাও সংঘর্ষপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। নিজস্ব আধিপত্য বিস্তার, জমি নিয়ে বিরোধ কিংবা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের মত এসব সংঘাত সংঘটিত সংঘর্ষ ঘটনা। এসব সংঘটিত সংঘাতে ব্যবহার হয় টেঁটা-বল্লমের মতো দেশীয় অস্ত্র। ঘর-বাড়িতে চালানো হয় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। সংঘর্ষগুলোতে টেঁটার ব্যবহার বেশি হওয়ায় এটি টেঁটা যুদ্ধ নামেও পরিচিত।


তবে এখন একটু একটু করে বদলে গেছে এসব অঞ্চল। দাঙ্গা-হাঙ্গামার কুফল সম্পর্কে পুলিশের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড ও কৌশলী নানা পদক্ষেপই এর বড় কারণ। এসব সংঘাতে পরবর্তী দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করা অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। আবার অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ কৃষিকাজে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। এছাড়া এসব দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হারও কমেছে।


স্থানীয় একজন বলেন, ‘দাঙ্গার হার নিরসন হওয়াতে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ভালো হয় এখন। আগের মতো এখন ঝরে পড়া নেই বললেই চলে। আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’


এক সময়ের দাঙ্গাপ্রবণ ধামাউড়া গ্রামটি এখন শান্ত এক জনপদে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরেও গ্রামটিতে ঘটেনি বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা। সংঘাতের পথ ছেড়ে এখানকার মানুষেরা মনোযোগী হচ্ছেন নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে। সন্তানদের আলোকিত করছেন শিক্ষার আলোয়। শুধু সরাইল নয়, পুলিশের নানা পদক্ষেপে শান্তি ফিরেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্যান্য দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে।


দাঙ্গাসহ অপরাধ নির্মূলে ২০২০ সালে বিট পুলিশিং কার্যক্রম শুরু করে জেলা পুলিশ। প্রতিটি ইউনিয়নকে আলাদা বিটে ভাগ করে নিযুক্ত করা হয় একজন উপ-পরিদর্শক। মূলত বিট পুলিশিং সভায় দাঙ্গার কুফলসহ অন্যান্য অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করা হয় স্থানীয়দের। এছাড়া কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় বিট কর্মকর্তাদের।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সোহাগ রানা বলেন, ‘একটা বিটে একজন নির্দিষ্ট অফিসার আছে, সেটা এলাকার মানুষ জানে। তাদের কাছে ওই অফিসারের ফোন নম্বর আছে। কোনো ঝামেলা হলে তারা কল দিচ্ছে, বিট থেকে সমাধান দেয়া হচ্ছে। যেটা সমাধান হচ্ছে না সেটা থানায় এসে মামলা করে যাচ্ছে। আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’


তবে বিট পুলিশিংয়ের পাশাপাশি মসজিদে খুতবায় দাঙ্গার কুফল সম্পর্কে সচেতন করা, এ ধরনের কাজে অংশ নিলে আইনি সহায়তা না দেয়া এবং কামারদের দেশীয় অস্ত্র বানানো বন্ধের মতো কৌশলী পদক্ষেপ নেন জেলা পুলিশ সুপার। এছাড়া দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত্র করতে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এরই মধ্যে ১২ হাজার দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।


গ্রাম্য দাঙ্গা পূর্বের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এখনও। আর এর বড় কারণ গ্রাম্য সরদারদের দু পক্ষের কাছ থেকেই আর্থিক সুবিধা নেয়ার প্রবণতা। অভিযোগ আছে এসব কাজে অর্থ সহায়তা দেন প্রবাসে থাকা স্বজনরা। তাই বিশিষ্টজনরা মনে করেন, দাঙ্গায় সহায়তাকারীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন করা জরুরি।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, ‘এখানে পুলিশের ভালো একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। আমি মনে করি দাঙ্গা যারা করে এবং এটাকে যারা উসকানি দেয় দুই পক্ষকেই যখন পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসছে তখন সংঘটিত দাঙ্গা কমছে।’


পুলিশ সুপার বলছেন, দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তি ও অর্থের যোগানদাতাদের তালিকা ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসছেন তারা।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সংঘটিত প্রবণ দাঙ্গাকে যারা উসকানি দেয় তাদের আমরা চিহ্নিত করে যেন আইনের আওতায় আনতে পারি এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। অনেককেই আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি।’


বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসব দাঙ্গাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ২০২০ সালে ১৭টি, ২০২১ সালে ১০টি, ২০২২ সালে ৪টি এবং ২০২৩ সালে মাত্র ৩টি বড় ধরনের দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।


বিবার্তা/আকঞ্জি/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com