ভয়ানক পর্যায়ে শিশুদের মোবাইল আসক্তি!
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪১
ভয়ানক পর্যায়ে শিশুদের মোবাইল আসক্তি!
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের শিশুরাও বাসায় যতক্ষণ থাকে প্রায় সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। কার্টুন দেখে, গেম খেলে। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই সময় কাটে তাদের। আর ছোট বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর সময় মোবাইলে ভিডিও না চালু করে দিলে খেতেই চায় না। না হলে কিছুতেই খাওয়ানো যায় না। প্রায় মা-বাবার কমন অভিযোগ এটি। বিষয়টি দিন দিন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে।


শিশুদের খেলার প্রধান মাধ্যম এখন মোবাইল এবং ট্যাব। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসে ডিজিটাল গেমে শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয়ে কোনো ক্লান্তি নেই। অভিভাবকদের চাপে কিংবা চোখ রাঙানিতে কেবল গেমস থেকে মুখ তুলতে বাধ্য হয় তারা।


খাওয়ানোর সময় শিশুর ডিভাইস আসক্তি এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। মানুষ যখন কোনো খাবার খায় সেটা খাওয়া আগে তার মুখে এক ধরনের তরল নিঃসৃত হয়। যা হজমে সাহায্য করে। বাচ্চারা যখন মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে খায় তখন তাদের মনোযোগ থাকে মোবাইলের দিকে। তাই খাওয়ার সময় মুখের সেই তরল নিঃসৃত হয় না। এতে হজমের সমস্যা হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ইবনে সিনার শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবু তৈয়ব হ্যাপী।


চট্টগ্রাম জামাল খান এলাকার গৃহকর্মী আমেনা আক্তার বলেন, ‘বাচ্চাদেরকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। সারাদিন মোবাইল ছাড়া কিছুই বুঝে না তারা। এখনই যেভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হচ্ছে বড় হয়ে যে কি হবে তা নিয়ে টেনশন হয়।’


এরকম দু-একজন নয়। শহর এলাকার প্রায় শতভাগ শিশুই স্মার্টফোনে আসক্ত। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। প্রায় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই একই অবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিভাইস আসক্তির মাধ্যমে কোমলমতি শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। ডিভাইস আসক্তি একদিকে শিশুদের যেমন মেধা ধ্বংস করছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে কর্মস্পৃহা। কমছে বিনোদন স্পট। ফলে ডিভাইস মুখী শিশুরা।


ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে।


শিশুদের ডিভাইস আসক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের জন্য বিনোদন স্পেস তথা খেলার মাঠ নাই। বিশেষ করে চট্টগ্রামে এই সমস্যা বেশি। তাই তারা ডিভাইসকেই বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে


এ বিষয়ে প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, ‘প্রথমে হয়তো কান্না থামাতে অল্প একটু সময় মোবাইল দিলাম, এভাবে ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে খাওয়ানোর সময় যে ডিভাইস আসক্তি এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। বাচ্চারা যখন মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে খায় তখন তাদের মনোযোগ থাকে মোবাইলের দিকে। এমনকি গ্রামের থেকে শহরের শিশুরা ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে বেশি।


সেভরন হাসপাতালের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, চোখের জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ পিটপিট করা, চোখ দিয়ে পানি পড়া এসব অভিযোগই বেশি শিশুদের। তিনি বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শিশুদের চোখের মাইনাস পাওয়ার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। যাকে বলে মায়োপিয়া। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা কাছের জিনিস ভালো দেখলেও দূরের জিনিস দেখতে পায় না। এ সমস্যা বাড়লে দূরের বস্তু আর দেখবেই না।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারে এখন শিশুদের খেলনার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে মোবাইল ফোন, সেটা অবুঝ শিশুদের জন্যে খেলনা মোবাইল আর বুঝমান শিশুদের জন্যে অ্যানড্রয়েট মোবাইল। শিশুর বায়না পূরণে মোবাইলে গেমস দেখা বা গান শোনা যেন এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে মোবাইল ফোনের বিকিরণের কারণে শিশুর চোখে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আগে শিশুদের গল্প শুনিয়ে খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো হতো। কিন্তু আজকাল সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোনে কিংবা টিভি। ফলে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা।


যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য মতে, দেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৬০ লাখ শিশু-কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে তারা।


দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট ব্যবহারে যেমন ক্ষতি হচ্ছে পড়াশোনার। তেমনি জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। অনলাইনে শিশুর সাইবার বুলিং, অনলাইনে যৌন নিপীড়ন, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া, প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।


ডিভাইস আসক্তি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে শারীরিক মানসিক অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে শিশুদের। একটা সময় পুরো প্রজন্ম রোগা হয়ে বেড়ে উঠবে। তাই যে কোনো মূল্যে ডিভাইস আসক্তি দূর করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।


বিবার্তা/জাহেদ/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com