নওগাঁয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে কমেছে পাটের দাম, হতাশ পাট চাষীরা
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৪৪
নওগাঁয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে কমেছে পাটের দাম, হতাশ পাট চাষীরা
নওগাঁ প্রতিরিধি
প্রিন্ট অ-অ+

নওগাঁর বিভিন্ন হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে সোনালি আশ খ্যাত পাট। তবে এ বছর মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি আর পানির অভাবে পাট জাগ দিতে না পারায় শঙ্কায় পড়েছিল জেলার পাঠ চাষিরা। খাল-বিল ও জলাশয় ছিল প্রায় পানি শূন্য। তবে সংসারের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে তীব্র খরায় শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে উৎপাদিত পাট বিক্রি করতে বাজারে এনে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ পাঠ চাষীরা।হাট বাজারগুলোতে সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানোর অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। চাষীদের পাটের ন্যায্য দাম দিতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


পাট চাষীদের অভিযোগ, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে জেলার স্থানীয় পাটের হাটগুলোতে মানভেদে প্রতি মণ পাটের দাম ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা কমানো হয়েছে। হাটগুলোতে বাজার মনিটরিং-এ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় পাটের দাম কমাচ্ছেন। এতে অনেক চাষীরা উৎপাদিত পাট হাটে এনেও কম দাম থাকায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি যারা বিক্রি করছেন তাদের হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।


জেলার সবচেয়ে বৃহত্তর পাটের হাটের মধ্যে একটি মান্দা উপজেলার সতিহাট। সম্প্রতি সরেজমিনে সতিহাটে দেখা যায়, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে কয়েক দফার বৃষ্টিপাতে জাগ দেওয়া সমস্যা কেটে যাওয়ায় বাজারে আকস্মিক পাটের আমদানি বেড়েছে।


মান্দা উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ সদর, আত্রাই ও মহাদেবপুর উপজেলা থেকে অনেক পাট চাষী এসেছেন এই হাটে পাট বিক্রি করতে। গত ২ সপ্তাহ আগে এই হাটে মানভেদে প্রতি মণ দেশী, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মানভেদে সেই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়।


মান্দা উপজেলার গণেশপুর গ্রাম থেকে ওই হাটে পাট বিক্রি করতে আসা চাষী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তীব্র খড়ায় এ বছর পাটের আবাদে সার, ঔষধ ও সেচ দিতে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়েছে। পাট কাটার পর জাগ দেওয়া থেকে শুরু করে শুকানো পর্যন্ত এক বিঘায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলন পেয়েছি মাত্র ৮ মণ। কিছুদিন আগে ২ হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে ৪ মণ পাট বিক্রি করেছি। ভেবেছিলাম দেরীতে বিক্রি করলে কিছুটা দাম বাড়বে। হাটে বাকী ৪ মণ পাট বিক্রি করতে এসে মাত্র ২ হাজার ১০০ মণ দরে বিক্রি করতে হলো। এভাবে পাটের দাম কমতে থাকলে এই দেশ থেকে একদিন সোনালি আঁশ হারিয়ে যাবে।


নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর গ্রাম থেকে পাট বিক্রি করতে আসা চাষী মাহমুদুল হাসান বলেন, ২ বিঘা জমিতে তোষা জাতের পাটের আবাদ করতে প্রায় ২৪ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়েছে। পানি স্বল্পতায় জাগ দেওয়ার সমস্যায় ১৪ মণ পাট পেয়েছি। ৩০ হাজার ৮০০ টাকায় এই পাট বিক্রি করতে হলো। কয়েক মাস শ্রম দিয়ে মাত্র ৭ হাজার টাকা লাভ কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না। কিছুদিন আগেও এই পাট বিক্রি করলে কমপক্ষে ৩৬ হাজার টাকা দাম পেতাম। ব্যবসায়ীরা নানান অযুহাত দেখিয়ে পাটের দাম কম দিচ্ছেন। চাষীদের পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।


তবে এসব অভিযোগ অকপটে অস্বীকার করেছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।


আলম হোসেন, দিলীপ কুমার, আব্দুল মজিদ ও শাহজামাল দয়াল নামে কয়েকজন পাট ব্যবসায়ী বলেন, মিল মালিকদের পাট কেনার আগ্রহ না থাকায় গত বছর বেশি দামে কিনে রাখা অনেক পাট ফড়িয়া ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুদ রয়েছে। এ বছর নতুন পাট বাজারে আসলেও তারা ভালো দাম হাঁকছেন না। তাই বেশি দাম পাট কিনে রাখার মতো সাহস ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না। এজন্য ঝুঁকি নিয়ে কম দামে পাট কিনতে হচ্ছে। মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের থেকে সাড়া পেলে তবেই পাটের দাম আবারো বাড়বে।


এখানে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে না বলেও দাবি করেন তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর নওগাঁ জেলায় ৫ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও ৪ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর, রাণীনগরে ৫৫ হেক্টর, আত্রাইয়ে ১৮৫ হেক্টর, বদলগাছীতে ১ হাজার ৩৫৫ হেক্টর, মহাদেবপুরে ১৯০ হেক্টর, পত্নীতলায় ১২৫ হেক্টর, ধামইরহাটে ৮৩০ হেক্টর এবং মান্দায় ১ হাজার ৪২০ হেক্টর রয়েছে। এ মৌসুমে দেশী, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট চাষ করেছেন কৃষকরা। যেখানে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ হাজার ৯০ টন। গত বছর জেলায় ৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করে ১৪ হাজার ৬৫২ টন পাট অর্জিত হয়েছিলো।


নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাট বপনের সময় বৃষ্টিপাত কম থাকায় এবং কর্তনের পর জাগ দেওয়া সমস্যার কারণে জেলায় প্রতি বছর পাটের আবাদ কমছে। এ বছর বৃষ্টিপাত না থাকায় পাট কর্তনের পর জাগ দিতে রিবন রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে চাষীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় খাল বিলে পানি আসায় পাট জাগ দেওয়ার সমস্যা কেটে গেছে। চাষীরা এবার তাঁদের উৎপাদিত পাট প্রায় ৭৫ কোটি টাকায় বিক্রি করতে পারবে বলে আশাবাদী তিনি।


নওগাঁ জেলা বাজার কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির বাজারে সর্বোচ্চ মূল্যে পাট কেনা-বেচার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাজারে সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানো সম্পূর্ণ বেআইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রশাসনের সহায়তায় বাজারগুলোতে অভিযান চালিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।


বিবার্তা/রাকিব/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com