শিরোনাম
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পুলিশি হেফাজতে ১০ কর্মকর্তা
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৭:২১
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পুলিশি হেফাজতে ১০ কর্মকর্তা
যশোর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহতের ঘটনা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বললেও তা মানতে রাজি নন হতাহতের স্বজনরা। তাদের দাবি কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ও তাদের পোষ্য নিরাপত্তাকর্মী-বন্দিদের দিয়ে নির্মম নির্যাতন ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রামাণও মিলেছে যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখে। একই আভাস দিয়েছেন খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম।


এদিকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ঘটনার দিন মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন। পরে দুই একজন দুই পক্ষের সংঘর্ষের কথা বললেও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেননি। তারা রহস্যময় আচরণ করেন।


তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার ৩ বন্দি নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ জন। নির্যাতনে মারা যাওয়া তিন কিশোর হলো- বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু প্রামানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), খুলনার দৌলতপুরের রোজা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮) ও বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮)।


এ ঘটনার পর শুক্রবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রটি বর্তমানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিন কেন্দ্রের সামনে নিহত, আহত ও বন্দিদের স্বজনরা ভিড় করেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করে।


এদিকে নৃশংসতার ঘটনায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়নি। গঠিত হয়নি তদন্ত কমিটিও।


যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিয় দাস বলেন, বৃহস্পতিবার দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মরদেহ আসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান এবং রাত ৮টায় আসে রাসেলের মরদেহ। এ চিকিৎসক বলেন, এক জনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরের আঘাতের বড় কোনো চিহ্ন শনাক্ত হয়নি।


আর এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিহত ও আহতদের ধরে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সংঘর্ষ হলে আঘাতের চিহ্ন ভিন্ন হয়।


কর্তৃপক্ষ মারপিটের ঘটনাটি বন্দিদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ দাবি করলেও আহতরা জানায়, কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ও তাদের পোষ্যদের দিয়ে তাদের দফায় দফায় পিটিয়েছে। সেকারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।


সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি চুয়াডাঙ্গার পাভেল বলে, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের প্রায় দুইশ’ জনের চুল কেটে দেয়ায় হাত ব্যথা ছিল। সেকারণে তার চুল পরে কেটে দেয়া হবে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে কয়েক কিশোর তাকে মারপিট করে।


এ বিষয়টি তিনি অফিসে জানান, কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে তারা মাদক সেবন করেনি।


পাভেল আরো জানায়, ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে তাদের অফিসে ডাকা হয় এবং এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ঘটনার আদ্যাপন্ত জানানোর একপর্যায়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্যান্য স্যাররা মারপিট করেন।


আহত আরেক কিশোর নোয়াখালীর বন্দি জাবেদ হোসেন জানায়, ‘স্যাররা ও অন্য বন্দি কিশোররা আমাদের লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে কুকুরের মতো মেরেছে। তারা জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে তা বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে মারধর করেন। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমর ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে আসেন। জ্ঞান ফিরলে ফের একই কায়দায় মারপিট করেছেন।’


যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার ঈষান জানায়, নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে। সে অভিযোগ করে, প্রবেশন অফিসার মারধরের সময় বলেন, তোরা বেশি বাড় বেড়েছ। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে।


শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদের দাবি, সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা চলে। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আশঙ্কাজনক একে একে আহতদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।


তবে তিনি সংঘর্ষ দুপুরে হলেও আহতদের সন্ধ্যায় পাঠানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব দেননি।


বৃহস্পতিবার কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে সংঘর্ষে ব্যবহৃত (তাদের বক্তব্য অনুযায়ী) লোহার রড-লাঠি কিভাবে বন্দিরা পেল, তার সদুত্তোর দিতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী বন্দিদের কাছে একটি ছড়ি কিংবা স্কেলও থাকার কথা না।


এদিন খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যেকারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।


তিনি বলেন, যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এই ঘটনার মূল সাক্ষি। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে।


এদিকে শুক্রবার যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) গোলাম রব্বানী শেখ জানান, এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত (বিকেল ৫টা) মামলা হয়নি। তবে, সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ কেন্দ্রে কর্মরত ১০ জনকে ভোরে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়। কেন্দ্রে তাদের রাখা ঝুঁকিপূর্ণ এবং মূল ঘটনার কারণ জানতে সমাজসেবা কর্মকর্তাদের পরামর্শে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে যশোর পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে রয়েছেন।


সমাজসেবা অধিদফতর যশোরের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ঘটনাটি আমরা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনি জানিয়েছেন- এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।


যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়েছে- স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের পর তদন্তশেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।


এদিকে, তিন খুনের ঘটনায় স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একইসাথে তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের সামনে স্বজনদের অবস্থান ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।


নিহত কিশোর পারভেজের বাবা খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকার রোকা মিয়া বলেন, আমার ছেলে প্রায়ই ফোনে বলতো এখানকার পরিবেশ ভাল না। কেন্দ্রে শিশু-কিশোরদের নির্যাতন করা হয়। গতকাল সকালেও সে ফোন করে তাকে বড় জেলখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলে। পারভেজ আরো বলে- আমাকে যদি না নিয়ে যাও, তাহলে আমার লাশ নিয়ে যেতে হবে।


কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে রোকা মিয়া বলেন, সত্যি সত্যিই আজ আমার সন্তানের লাশ নিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান।


নিহত অপর কিশোর রাসেলের ভাই বগুড়ার শেরপুর এলাকার ফরহাদ আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে ভাই হারানোর বেদনা বোঝেন। তিনি নিশ্চয়ই এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করবেন।


তিনি জানান, কেন্দ্রে থাকাকালে তার ভাই এখানে খাবার প্রদানে অনিয়মসহ বন্দিদের উপরে নানাধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল। তিনি এই ঘটনার বিচার দাবি করেন।


নিহত নাঈমের ভাই বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকার শামিম প্রামাণিক জানান, তার ভাই এই কেন্দ্রে ৬ মাস আগে আসে। মৃত্যুর সংবাদ তাদের পরিবারের কাউকে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। টিভিতে খবর দেখে ছুটে এসেছি।


এদিকে শুক্রবার সকালে আহত রুপককে (১৫) যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে মোট ১৫ জন। অন্যরা হলো- জাবেদ (১৭), আরমান (১৬), হৃদয়(১৬), লিমন (১৬), শাকিব (১৬), ঈশান (১৫) পাভেল (১৬), শরিফুল (১৬), সাব্বির (১৬), হৃদয়-২(১৭) মাহিম (১৭), রাকিব (১৬), সাব্বির (১৬), নাঈম ও (১৩)।


এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী), সিপিবি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাসদ (মার্কসবাদী), বাসদ নেতৃবৃন্দ।


বালকদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। এ কেন্দ্র মোট বন্দির সংখ্যা ২৮০ জন।


যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এই তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার যে উন্নতি হয়নি; বরং অবনতি হয়েছে।


২০১১ সালের ২৯ আগস্ট আকাশ (১২) নামে এক শিশুকে প্রথমে শ্বাসরোধ ও পরে টিনের টুকরো দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে নূর ইসলাম (১৫) নামে এক শিশু আত্মহত্যা করে। এছাড়া ২০১৪ সালে ৫ মে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দর্শনার্থী একজন অভিভাবককে মারধরের অভিযোগের জের ধরে এ সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়। এ ঘটনার পর কেন্দ্রের আটজন পুলিশকে প্রত্যাহার করে অন্য একটি দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়।


বিবার্তা/তুহিন/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com