
হতদরিদ্র ঘরের সন্তান ইয়ারজান বেগম। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি গোল ঠেকিয়ে বিজয়ের মূল কারিগর গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগম। তার অসাধারণ নৈপুণ্যে ভারতের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয় পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
সাফ ফুটবল জয়ী ইয়ারজানের বাড়ি পঞ্চগড় উপজেলা সদরের হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক শারীরিকভাবে অসুস্থ- দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। চলাফেরা করতে পারলেও কাজ করতে পারেন না। মা রেনু বেগম অন্যের বাড়ি এবং ক্ষেত-খামারে কাজ করে দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ টাকা রোজগার করেন। সেই আয় দিয়েই কোন রকমে চলে চারজনের সংসার।
অভাবের সংসারে দুইবেলা ঠিকমত খাবার জুটত না ইয়ারজানের। এই অনটনের সংসারেও হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করত সে। স্কুলের হয়ে জেলা পর্যায়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয় ইয়ারজানের ফুটবল দল।
প্রত্যন্ত এলাকার গরীব ঘরের মেয়ে, তার উপর আবার ফুটবল! ইয়ারজানের ফুটবল খেলা মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় মুরুব্বিরা। ইয়ারজানের খেলাধুলায় বাধা হয়ে উঠেছিলেন তারা। তবে বাবা মা’কে বুঝিয়ে, লোক লজ্জা পিছনে ফেলে এগিয়ে যান তিনি। জেলা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার বিভিন্ন লীগ ও ক্লাবের হয়ে খেলে গৌরব অর্জন করেন এই ফুটবলার।
সর্বশেষ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে দেশের হয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার খবরে এখন যেন ইয়ারজান শুধু হাড়িভাসার খোপড়াবান্দির নয়- পঞ্চগড়সহ দেশের গর্ব হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিজয়ের পর থেকেই দেশের ফুটবল প্রেমীদের সাথে আনন্দে ভাসছে ইয়ারজানের পরিবারসহ এলাকার মানুষ।
ইয়ারজানের মা রেণু বেগম বিবার্তাকে বলেন, আমার মেয়ে দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনবে কখনো ভাবতে পারিনি। তবে খেলার জন্য আমি ইয়ারজানকে অনেক মারপিট করেছি, অনেক বকাবকি করতাম, ভয় দেখাতাম। খেলতে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্তু সে লুকিয়ে চলে যেত খেলতে। পরে যখন বুঝলাম সে ভালো খেলতেছে, তখন আর গালি দিতাম না। তবে খেলতে যাওয়ার জন্য রিক্সা ভাড়া দিতে পারতাম না। ওর বাবা অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। আমার আড়াইশ টাকা মজুরির আয় দিয়ে দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। তাকে কখনো ভালো কিছু খাওয়াতে পারিনি। অনেক সময় সে না খেয়েই খেলতে চলে যেত। এখন সে বিদেশের মাটিতে খেলে ভালো করেছে। আমরা অনেক খুশি হয়েছি। গর্বে বুকটা ভরে গেছে। আমাদের মত এলাকার সবাই খুশি হয়েছে।
ইয়ারজানের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সামুস কিবরিয়া প্রধান বিবার্তাকে বলেন, ইয়ারজানের নেতৃত্বে আমাদের স্কুল আন্তঃজেলা পর্যায়ের ফুটবল লীগে পরপর তিনবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গোলকিপার ছাড়াও সে ফুটবলে বিভিন্ন পজিশনে ভালো খেলে। ইয়ারজানের পরিবার অনেক দরিদ্র। স্কুল পর্যায়ে তাকে খেলার জন্য আমরা অনেক সহযোগিতা করেছি। পঞ্চগড়ে গিয়ে ভালো কোন জায়গায় খেলবে এমন পরিস্থিতি তার ছিল না। তারপরেও কষ্ট করে সে পঞ্চগড়ে খেলতে যেত। ইয়ারজান শুধু আমাদের বিদ্যালয়ের গর্ব না, সে এখন সমগ্র বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের গর্ব। আমি ইয়ারজানের সর্বময় মঙ্গল কামনা করি। সে যেনে দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পারে।
ইয়ারজানের কোচ টুকু রেহমান বিবার্তাকে জানান, জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন খেলার সময় ইয়ারজানের প্রতিভা আমি দেখেছি। সে শুধু গোল রক্ষকই না, পুরো মাঠ জুড়ে খেলতে পারে। তারপর তাকে নিয়ে আসি আমার টুকু ফুটবল একাডেমিতে। তাকে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করি। তবে সংসারে দরিদ্রতার কারণে প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরের মাঠে প্রশিক্ষণে যাওয়ার রিক্সা ভাড়াও দিতে পারতেন না ইয়ারজানের বাবা-মা। খাবারের পয়সা জোগাতেই সেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে খেলার জন্য টাকা খরচ করা ইয়ারজানের পরিবারে পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইয়ারজানকে জাতীয় দলে অর্ন্তভুক্ত করলে সে আরও ভালো করবে বলে আমার বিশ্বাস।
জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, ইয়ারজান আমাদের গর্ব। ইতোমধ্যে আমি ইয়াজানের বাড়িতে গিয়েছি। আসলে তার পরিবার হতদরিদ্র। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তাকে একটি ঘর করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ইয়ারজানের পরিবারে পাশে আছি।
বিবার্তা/রোমেল/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]