দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ ফোন (জিপি) এখন গ্রাহক হয়রানিতেও শীর্ষস্থান দখল করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্বল নেটওয়ার্ক, কল ড্রপ, বিরক্তিকর এসএমএস, ইন্টারনেট প্যাকেজ বিড়ম্বনা, কল সেন্টারের গ্রাহক সেবা পেতে ভোগান্তিসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রামীণফোনের (জিপি) গ্রাহকরা।
সারাদেশের ৩০ জনেরও বেশি জিপি গ্রাহক এসব ভোগান্তি নিয়ে বিবার্তায় অভিযোগ এ বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিপির কল ড্রপ যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি কিছু সার্ভিসে প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছেন তারা। এর একটি হচ্ছে সময়ে-অসময়ে পাঠানো অপারেটরটির প্রচারণামূলক এসএমএস। সারাদিন তো আছেই, এমনকি গভীর রাতেও তাদের মোবাইলে এসব এসএমএস আসছে বলে অভিযোগ করছেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা।
কল ড্রপ বা বিরক্তিকর এসএমএসের বাইরে ইন্টারনেট নিয়েও গ্রাহকদের রয়েছে নানান অভিযোগ। প্যাকেজ থাকার পরও সরাসরি টাকা কেটে নেয়া, ঠিকমতো সংযোগ না পাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তাদের। এসব ব্যাপারে গ্রাহকদের অভিযোগের কোনো সুরাহাও হচ্ছে না।
জিপি নেটওয়ার্ক সেবার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী তন্নির। তিনি বিবার্তাকে জানান, রোকেয়া হলে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। হলে আমরা সকলে এর ভুক্তভোগী। গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি। ১০ বছরের পুরানো নাম্বার, না হলে কবেই সিমটা ভেঙে ফেলতাম!
বেসরকারি টিভি চ্যানেল 'জিটিভি'র কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক অঞ্জন রায় বিবার্তাকে বলেন, আমি ৮২৯ টাকা দিয়ে ৩ জিবি ইন্টারনেট প্যাকেজ অ্যাক্টিভ করি। সেটা অ্যাক্টিভ না হওয়াতে জিপির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে বিষয়টি জানালে তারা দাবি করে, আমি নাকি টাকাই রিচার্জ করিনি। পরে যখন রিচার্জ সংক্রান্ত সব ডকুমেন্ট দিলাম তখন তারা আমাকে ওই ইন্টারনেট প্যাকেজটা অ্যাক্টিভ করে দিলেন। আর কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
অঞ্জন রায় বলেন, আমার বেলায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে প্রতিদিন অসংখ্য জিপি গ্রাহক ভোগান্তিতে ভুগছে তার কি কোনো সমাধান হচ্ছে?
জিপি মোবাইল অপারেটরের কলরেট নিয়ে অভিযোগ করেছেন বিবার্তার সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি। তার ভাষায়, আমি ৫৮ সেকেন্ড কথা বলেছি, খরচ হিসেবে নিয়েছে ১ টাকা ৯৭ পয়সা, আবার আরেক কলে ৩৩ সেকেন্ডের জন্য কেটে নিয়েছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা।
জিপি কলরেটের আরেকজন ভুক্তভোগী মো. নুরনবী হুসেন নিলয়। তিনি জানান, ব্যালেন্স চেক করেছি দেখলাম ১৯ টাকা আছে। এক মিনিট কথা বলে পরেরবার কল দিতে গিয়ে দেখি, হায় হায়! একি অবস্থা!কোম্পানির পক্ষ থেকে বলে যে, কল করার জন্য আপনার পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই!
রেহানা পারভিন রুমি। দিনাজপুর বীরগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)। জিপি মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবার ভোগান্তি নিয়ে তিনি বিবার্তাকে বলেন, জিপি নেটওয়ার্কের একটা বড় সমস্যা হলো, কথা বলার সময় হঠাৎ নেট কেটে যাওয়া। এটা একটা বিরক্তিকর অবস্থা, সেই সাথে টাকাও অপচয়। এই ক্ষতিপূরণ তো জিপি দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনলে নেট শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ফোনের ব্যালেন্স হাওয়া হয়ে যাওয়া। নির্দিষ্ট প্যাকেজের মেয়াদ থাকাকালীন ব্যালেন্স শেষ হওয়ায় ইমার্জেন্সি ব্যালেন্সে প্যাকেজের কলরেট না কেটে বেশি কাটে। কোনো অফারে প্রলুব্ধ করার জন্য ফোন করলে সম্মতি না থাকলেও কখনো আপনা-আপনি নির্দিষ্ট ব্যালেন্স কেটে নিয়ে অফার চালু করে দেয়। অসংখ্যবার এভাবে আমার ফোনের ব্যালেন্স কেটে নেয়ার পর আমি বাধ্য হয়ে কথা বলার জন্য একটা সিম আর শুধু নেট চালানোর জন্য অন্য আরেকটা সিম ব্যবহার করছি।
ছাত্রলীগ, কুষ্টিয়া জেলা ইউনিটের এক্স-জয়েন্ট সেক্রেটারি ফুয়াদ হাসান জিপির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে জানান, আমি জিপি কল সেন্টারে কল দিয়ে কাস্টমার ম্যানেজারের সাথে কথা বলার অপশন পাই না। জিপির ১২১ এই নম্বরে কল করলে সেন্টার থেকে যা প্রয়োজন নেই সেটা আগে বলে। কিন্তু কাস্টমার ম্যানেজারের সাথে কল দেয়া যায় না।
দীর্ঘদিন ধরে জিপি নেটওয়ার্ক সেবা ব্যবহার করছেন বিজনেসআওয়ার২৪.কমের সিনিয়র সাবএডিটর পলাশ সেপাই। জিপির সেবা নিয়ে তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমার গ্রামীণফোনের সেবার বিভিন্ন ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন- বিনা কারণে ব্যালেন্স থেকে টাকা কেটে নেয়া, মিনিটপ্রতি নির্দিষ্ট চার্জের চেয়ে বেশি কেটে নেয়া। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় মেসেজ দেয়া। মেসেজের যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যায়।
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে মাস্টার্সে শেষ বর্ষে পড়াশুনা করছেন নাটোর বনপাড়ার জেনি গমেজ। জিপির গ্রাহক হিসেবে তিনি কোম্পানির প্রতি সন্তুষ্ট না। তার অভিযোগ, সারাদেশে অভিন্ন কলরেট কার্যকর করার ফলে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে জিপির বাজে নেটওয়ার্ক। রাজধানীতে থেকেও ঘরে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। আবার কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কল কেটে যায়। এছাড়া ২৪ ঘণ্টা আজেবাজে মেসেজের অত্যাচারে জীবন অতিষ্ঠ। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে এমবির প্যাকেজ শেষ হলে মূল ব্যালেন্স থেকে মুহূর্তেই সব টাকা কেটে নেয়। প্রশ্ন হলো, এমবি শেষ হলে ইন্টারনেট অফ করে দিক, মূল ব্যালেন্স থেকে টাকা কেটে নেয় কেন?
ফরিদপুর থেকে সুব্রত মানিক জানান, জিপির সময়ে-অসময়ে পাঠানো প্রচারণামূলক এসএমএসে জীবন অতিষ্ঠ। দিনরাত শুধু ইন্টারনেট প্যাকেজ অফার, টকটাইম অফার, এসএমএস অফার, বায়োস্কোপ ভিডিও দেখার অফারসহ হরেক রকম অফারের মেসেজ শুধু আসতেই থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে জিপি মোবাইলফোন অপারেটরের সেবা নিচ্ছেন বিবার্তা২৪নেটের অপরাধ বিভাগের স্টাফ রিপোর্টার খলিলুর রহমান স্টালিন। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে ইমার্জেন্সি লোনের জন্য আবেদন করলে ১০০ টাকা লোন হিসেবে দেয়া হয়। সে টাকা শেষ না হতেই তিনি ১০০ টাকা রিচার্জ করেন। সেটা সাথে সাথে লোনের ফেরত হিসেবে কেটে নেয়া হয়। আবার ১০০ টাকা রিচার্জ করেন। সেটাও কেটে নেয়া হয়। ব্যালেন্স চেক করে দেখেন শূন্য। আবার ১০০ টাকা রিচার্জ করেন, তখন ব্যালেন্স যোগ করা হয়। এছাড়াও কলড্রপের যন্ত্রণা তো নিত্যদিনের ঘটনা। এভাবেই জিপির সেবা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলেন খলিলুর রহমান স্ট্যালিন।
গ্রামীণফোন অপারেটরের ভুক্তভোগী অপর এক গ্রাহক শাহনাজ শারমিন জানান, জিপির কলরেট বেশি। আর আমার একটা জিপি নম্বরে রিচার্জ করলেই টাকা কেটে নেয়া হয়। ১০০ টাকা রিচার্জ করলে পরে দেখা গেছে মাত্র ১৭ টাকা রয়েছে। কিন্তু আমি তো কোনো কল করিনি। তাহলে আমার বাকি টাকা গেল কোথায়?
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব রায় সুজন জানান, প্রায় প্রত্যেক দিনই কোনো-না-কোনোভাবে জিপির দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছি। গ্রামীণফোন তিলে তিলে কাস্টমারের সাথে প্রতারণা করছে।
আদনান শাওন জানান, গ্রামীণফোণের সেবা নিয়ে তার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটা হলো- অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সার্ভিস চালু করে দেয়া।
এ ব্যাপারে গ্রামীণফোণের হেড অব কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামাল বিবার্তাকে বলেন, গ্রামীণফোন গত ২১ বছর ধরে বাংলাদেশে সেরা মানের সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাহকসেবা দিয়ে আসছে। বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আজ সাত কোটির উপর গ্রাহকের পরিবার। গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা গ্রাহকসেবা কেন্দ্র, ১২১ হটলাইন, ফেসবুক পেজ, অনলাইন চ্যাটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন। গ্রাহকের সুনির্দিস্ট অভিযোগ থাকলে গ্রামীণফোন তাকে স্বাগত জানাবে এবং সমাধানের চেষ্টা করবে। সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে কলড্রপের হার, এসএমএস, বা সেবা সংক্রান্ত প্যাকেজ নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ীই পরিচালনা করা হয়। তবে কোনো গ্রাহক যদি কোম্পানির প্রমোশনাল এসএমএস পেতে না চান তাহলে আমাদের ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ অপশন চালু করে এ ধরনের সেবা নেয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, ফোর-জি চালুর পর নেটওয়ার্কব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কথা বললেও দিনদিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই সাথে কলড্রপের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে থাকার শর্ত থাকলেও অপারেটররা তা মানছে না। কোনো ক্ষতিপূরণও প্রদান করছে না। প্রমোশনাল ম্যাসেজের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে গ্রাহকরা মেসেজের যন্ত্রণায় ত্যক্তবিরক্ত। এমনকি গভীর রাতে মেসেজ আসার ফলে অনেক হৃদরোগী আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আমরা মনে করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার ফলেই অপারেটররা গ্রাহকদেরকে ভোগাতে সাহস পাচ্ছে।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]