ক্ষতি জেনেও প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার চলছে দেশজুড়ে। নিষিদ্ধ এই পণ্য ব্যবহারে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। বিষয়টি সবার কাছে একেবারেই স্বাভাবিক।
বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেল। প্রায় সব দোকানে প্রকাশ্যে বাজারের ব্যাগ হিসেবে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা অবশ্য বলছে ক্রেতাদের চাহিদার কারণেই তারা প্লাস্টিক ব্যাগ রাখতে বাধ্য হন। ব্যাগ না রাখলে ক্রেতারা পণ্য কিনতে চান না।
আব্দুল জলিল প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরেন হাতে কোন না কোন পণ্য নিয়ে। এসব পণ্য বহন করার জন্য ব্যবহার করেন প্লাস্টিকের ব্যাগ- যা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। শুধু তিনিই নন, এভাবে পণ্য বহন করেন প্রায় সবাই। ক্ষতি জেনেও সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় যথেচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যবহার চলছে।
আব্দুল জলিল অকপটে বিবার্তাকে বলেন, আমি জানি প্লাস্টিক ক্ষতিকর দ্রব্য। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যস্থতা। এটার ব্যবহার থেকে বের হতে পারছি না। বিক্রেতারাও উৎসাহিত করেন ব্যবহার করার জন্য।
ফারদিন তার পরিবারের চার সদস্যের জন্য বাজার করেন সপ্তাহে তিনদিন। তিনিও প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি বির্বাতাকে বলেন, যেকোন কাজের জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার এখন অত্যাবশ্যকীয়। পরিবেশ বান্ধব কীনা সেভাবে ভাবা হয়ে ওঠেনি। বাজারে তো এর বিকল্প নেই যে তা ব্যবহার করবো।
২০০২ সালে প্রথমবারের মতো পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও এর ব্যবহার না কমে বরং বেড়েছে। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে পলিথিন ব্যাগ।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় একজন মানুষ বছরে ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করেন। ২০০৫ সালে করতেন ৯ কেজি। এ হিসাবে ১৫ বছরে ঢাকার মানুষের প্লাস্টিক ব্যবহার বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি।
অন্যদিকে ঢাকাতে একবার ব্যবহারের পর ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন মাটিতে ফেলা হচ্ছে যার গন্তব্য নালা, খাল ও নদী হয়ে সাগর।
চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুজনিত রোগসহ নানা রোগের জন্য দায়ী প্লাস্টিককে আলাদা করে সংগ্রহ করার কাজ খুব কমই চোখে পড়ে। ক্যানসার, শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক কণা থেকে যা ঢাকার বাতাসে একেবারেই নতুন। প্লাস্টিক নিয়ে বাংলাদেশের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে মাটি, পানি, নদী ও সমুদ্রের মাছের মধ্যে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পান গবেষকেরা। ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় মানুষের রক্তেও প্লাস্টিকের উপাদান পাওয়া যায়।
ঢাকার বাতাসে এক নতুন বিপদ অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। তবে এত দিন বাতাসে নানা দূষিত বস্তুকণার পাশাপাশি শঙ্কা বাড়িয়েছে অতিভারী ধাতুর অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় ঢাকার মোট ১৩টি এলাকার বাতাসের নমুনা নেয়া হয়। এলাকাগুলো হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১৩, পশ্চিম কাজীপাড়া, শান্তিনগর, আরামবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ও ফজলুল হক হল, খিলক্ষেত, ফার্মগেট, মহাখালী, মুগদা, বাসাবো। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার বাতাসের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়।
ঢাকা মহানগর প্লাস্টিক ও পলিথিনের বোমার ওপর বসে আছে। এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
জেলার সরকারি অফিসসমূহে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চের ১ তারিখে মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিশাখা-১ থেকে প্রেরিত পত্রে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার সকল সরকারি অফিসসমূহে এবং উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধকল্পে মাসিক সভা ও অংশীজনদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভা আয়োজন এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার রোধকল্পে গৃহীত কার্যক্রম এবং পরিবেশ দূষণ সম্পর্কিত এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর ফারহিনা আহমেদের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকগণের সাথে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
ব্যবহৃত প্লাস্টিককে অন্য কিছুতে রূপান্তর হতে পারে একটি সমাধান। প্লাস্টিক রিসাইকেলের উপরে জোর দিতে হবে পরিবেশবিদরা বলে আসছেন।
এসব নির্মূলে ছোট ছোট উদ্যোগ বদলে দিতে পারে অপচনশীল প্লাস্টিকের ছড়িয়ে পড়া। যা প্রকৃতি তো বটেই, মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য অন্যরকম একটি উদ্যোগ নিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
বিদ্যানন্দের একজন স্বেচ্ছাসেবক বিবার্তাকে জানায়, অপচনশীল প্লাস্টিক সংগ্রহ করছে রিকশা বিন। সুন্দর বিনটি রিকশার পেছনে বেধে রিকশা চালানোর পাশাপাশি রিকশা চালক সংগ্রহ করবে প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য।
এ বিষয়ে তিনি আরো জানান, ঢাকা সিটিতে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য প্রধান সড়কগুলোতে ফুটপাতের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে ছয় হাজার ময়লার বিন স্থাপন করা হয়। কিন্তু স্থাপনের এক বছরের মধ্যে এই বিনগুলো হারিয়ে যেতে থাকে।
ফুটপাতে বিন না পেলেও অলিতে গলিতে পাবেন অসংখ্য রিকশা। কেমন হবে, যদি রিকশার পেছনেই রাখা যায় এমন প্লাস্টিক সংগ্রহ করার বিন?
অপচনশীল প্লাস্টিক, কাগজ ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ করবে নান্দনিক ডিজাইনের এই রিসাইকেল বিন। দিন শেষে সে প্লাস্টিকের বিক্রয়লব্ধ অর্থে কিছুটা হলেও সাপোর্ট পাবে রিকশাচালক নিজেই। আর শহরটাও থাকবে প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত।
ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে হচ্ছে টাইলস
এ উদ্যোগের অন্যতম কারিগর গ্রো গ্রিন বাংলাদেশের সভাপতি ফজলুর রহমান বাবু বিবার্তাকে বলেন, গত এক বছরের নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম, নির্ঘুম রাত আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য আগ্রহের ফল এখন দৃশ্যমান। Go Green Bangladesh এর ময়লা থেকে তৈরি টাইলসের এই পথ ধরে ঘরে ফিরবে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের জেলেপাড়ার মানুষ। এ কাজটা সফলতার সাথে করা সম্ভব হয়েছে।
প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, পাটের ব্যাগ আমাদের এখানে আগে বাজারের ব্যাগ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখন সবাই খালি হাতে বাজারে গিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে করে বাজার নিয়ে ফেরে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পণ্যকে মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারে শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হলেও কমেনি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতির কথা চিন্তা করে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। তখন বিকল্প হিসেবে কাগজ ও পাটের ব্যাগের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে আইনের প্রয়োগ না থাকায় পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। তবে বাংলাদেশে প্রতিদিন কী পরিমাণ পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার হয় এবং শেষে বর্জ্য হিসেবে নালা-নর্দমা, খালবিলে জমা হয়, এ নিয়ে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের প্লাটফর্ম ‘আর্থ ডে নেটওয়ার্ক’ এর এক গবেষণায় দেখা যায় পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রথমে আছে- চীন, ভারত ১২তম অবস্থানে, পাকিস্তান ১৫তম ও মিয়ানমার ১৭তম অবস্থানে আছে।
বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/জবা
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]