‘জাতির প্রয়োজনে আবার জেগে উঠবে গণজাগরণ মঞ্চ’
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:১৯
‘জাতির প্রয়োজনে আবার জেগে উঠবে গণজাগরণ মঞ্চ’
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নেন দেশপ্রেমিক, মুক্তমনা মানুষ। গড়ে ওঠে আন্দোলন। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হলেও থেমে থাকেনি গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলন।


দশ বছর আগে রাজধানীর শাহবাগে দাঁড়ানো বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তমনা, প্রগতিশীলদের সেই আন্দোলনের দশক পূর্তি হয়েছে রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি)। বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে গণজাগরণের দশক পূর্তি অনুষ্ঠান শুরু হয়। গান, কবিতা ও আলোর মিছিলে গণজাগরণের দশক পূর্তি পালন করেন সংগঠকরা।


দশ বছর আগে নানা দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে জড়ো হওয়া বিশিষ্টজনদের সাথে কথা বলেছে বিবার্তা। ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে তারা বলছেন, সেই সময়ে তোলা দাবির বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করেছে সরকার। তবে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধসহ আরো বেশ কিছু দাবি এখনো অপূর্ণ রয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া, রাজাকার মুক্ত দেশ গড়তে এসব দাবির বাস্তবায়ন করা দরকার।


সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বিবার্তাকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে দেশের তরুণরা জেগে উঠেছিল। তরুণদের সেই জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল। মানুষ দেখেছে যে দাবি নিয়ে তরুণরা সেই সময়ে এক হয়েছিল, তার অনেক রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে দিয়ে আমাদের কপালে যে কলঙ্ক ছিল তা মুছেছে।


তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আবারো সমবেত হয়েছি। যতদিন দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যাবে না, ততদিন এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।


গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, এতোদিন শাহবাগের প্রজন্ম এক সাথে ছিলো না, তার মানে এই নয় যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটা মনে রাখতে হবে, শাহবাগ জেগে থাকে কখনো ঘুমায় না। দেশে নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত চলছে। এসব এমন কোনো পর্যায়ে গেলে এই প্রজন্ম আবারও জেগে উঠবে।


তিনি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ যে সংগঠিত হয়েছিল- তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা একটা মেসেজ। তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস থেকে মেসেজ পেয়ে যাবে। তারা একটা মেসেজ নিয়েই বড় হচ্ছে যে এই দেশে মৌলবাদের ঠাঁই হবে না।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বিবার্তাকে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ একটি আন্দোলন যা বাংলাদেশের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের নতুন ইতিহাস সৃষ্টিতে বিশাল একটি ভূমিকা রেখেছে। কাদের মোল্লার রায়ের যখন বিপর্যয় ঘটে, তখন এই জায়গা থেকে সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছিল। আজ ১০ বছর পর মনে করি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন এখনও চির জাগরুক রয়েছে। শত শত বছর পরও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওই আন্দোলন মনে রাখবে। এই দিনটি আমাদের অর্জনের দিন, নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিন।


তিনি বলেন, সেদিন গণজাগরণ মঞ্চ না হলে আজকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে আস্ফালন তার কয়েকশ গুণ দেখতে পেতাম। গণজাগরণ মঞ্চ প্রমাণ করেছে এই বাংলাদেশ কখনো রাজাকার, আলবদরদের হবে না। তরুণ প্রজন্ম তাদের মেনে নেয়নি, বর্তমান প্রজন্ম মেনে নেয়নি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মও মেনে নিবে না।



শিল্পী আল আমিন বাবু বিবার্তাকে বলেন, ১০ বছর পর এখানে দাঁড়ানোর অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। ঐশ্বরিক অনুভূতি। জাতি যখন চরম সংকটের মধ্যে তখন আমরা দাঁড়িয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের এতো ঔদ্ধত্য ছিল যে, ওরা কখনো ভাবেনি ওদের বিচার করা যাবে। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। আমরা দলমত নির্বিশেষে দাঁড়িয়েছিলাম।


স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আন্দোলনের প্রথম দিকে একটা মাইক নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলাম- আমরা এই ট্রাইব্যুনাল মানি কিন্তু বিচার মানি না। পাকিস্তানি শক্তি, মৌলবাদের পতন দেখতে চাই। তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিশ্বনেতাদের প্রেসার ছিল। কিন্তু মানুষ যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেটা টেকেনি। আমাদের দাঁড়ানোর সবচেয়ে সফল একটা দিক ছিল এটি। আমাদের যুদ্ধটাও ছিল স্বাধীনাতার মতো। মুক্তিযুদ্ধের পর যারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, ২০১৩ সালে এই দিনে আমরা তাদেরকে কবর দিয়েছি। এই দেশ বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। মৌলবাদের ঘাঁটি হতে পারে না।


গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও গৌরব ‘৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন বিবার্তাকে বলেন, শাহবাগ জেগে থাকে, ঘুমায় না। ১০ বছরে দাঁড়িয়ে আমারা সমস্বের বলেছি, জাতির পিতা শেখ মুজিবের আদর্শ নিয়ে কাঙ্খিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজনে প্রতিটি যোদ্ধা আবার রাস্তায় নামবে। লড়াই করবে। সকল অপশক্তিকে আবার রুখে দাঁড়াবে।


যারা দেশবিরোধী তারা ষড়যন্ত্র করছে। সংবিধান নিয়ে হুমকিও দিচ্ছে। আমরা জেগে ছিলাম, জেগে থাকব। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ধারণ করে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিবে- আজকের দিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


লেখক ও ব্লগার মারুফ রসূল বিবার্তাকে বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগে যারা মায়ের হাত ধরে এসেছিলো তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে যেখানেই থাকুক তার নিরন্তর সংগ্রাম আছে। অনলাইনের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবস্থান দেখতে পাই। এটা আমাদের অর্জন।


গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক খান মাসুদুজ্জামান মাসুম বিবার্তাকে বলেন, ১০ বছর আগে আমরা শাহবাগে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই দাঁড়ানোর ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে আমরা অভিশাপমুক্ত হয়েছি। স্বাধীনতাবিরোধীদের উসকানি এখনো অব্যাহত আছে। সেই জন্য গণজাগরণ এখনো প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এজন্য আমরা আবার একত্রিত হয়েছি। গণজাগরণ মঞ্চ সবসময় জেগে থাকে, এর বিকল্প নেই।


তিনি বলেন, ১০ বছরে আমাদের অনেকগুলো দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতি, অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে আমরা কথা বলছি। সামনে সাম্প্রদায়িক শক্তি আরো জোরালোভাবে আসছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে রাষ্ট্রধর্ম আছে। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকতে পারে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম পরিহার করা উচিত।


বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু বিবার্তাকে বলেন, আমাদের অনেক চাওয়া ছিল। রাজনৈতিক শক্তিগুলো পারছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন, তখন তরুণ প্রজন্ম জনগণের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিল। তারা একত্রিত হয়ে কাজটা করল। যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের কাজকে তারা ত্বরান্বিত করতে পেরেছে। জাতির পিতা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যা ক্ষমতায় আসার পর তার পথও মসৃন ছিল না। তরুণ প্রজন্ম সেই সময়ে একত্রিত হয়ে জনগণের পক্ষ থেকে সমর্থন দিয়েছে। এই কাজটা করার জন্য তাদের স্যালুট করি।



তিনি বলেন, সরকার আমাদের আশা-আকাঙ্খার অনেকটা বাস্তবায়ন হয়েছে। সেই জাগরণ এখন আর দরকার নেই। তবে মনে করি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া, রাজাকার মুক্ত দেশ গড়তে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দরকার।


ব্লগার অনিমেশ রহমান বিবার্তাকে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ এখনো শেষ হয়নি, জেগে আছে। মিছিল, মিটিংয়ে হয়তো নেই, কিন্তু যখনি জাতির প্রয়োজন পড়বে আবার জেগে উঠবে। নতুন প্রজন্মকে আমাদের চার মূলনীতিকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।


কলামিস্ট লীনা পারভীন বিবার্তাকে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ হচ্ছে একটা চেতনার নাম। কোনো সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। ২০১৩ সালে আমরা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে আাবার গণজাগরণ তৈরি করেছি। আমরা এটাকে বলি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। কারণ আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে গল্পের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুনেছি।


তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। দেশ মাতৃকার কলঙ্কমুক্তির দায়িত্বটা আমরা পালন করেছি। এখন নতুন প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব। তারা এই চেতনা বয়ে নিয়ে চলুক। যারা চেতনাকে ধারণ করতে পারবে না, তারা ঝড়ে পড়বে।


সাতক্ষীরা গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক নাসরিন খান লিপি বিবার্তাকে বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল। সেই সময়ে এক মাস ২৩ দিন আমরা সাতক্ষীরায় গণজাগরণ মঞ্চ করেছি। আমরা জায়গা ছেড়ে যাইনি। যেদিন জেনেছি জামায়াত-শিবির শহরে উঠতে পারবে না তখন ছেড়েছি। সেই অপশক্তি এখনো বসে নেই। তারা বড় আকারে ঘটনা ঘটাতে চায়। এদেরকে প্রতিহত করতে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এরা জেগে উঠলে বাংলাদেশ আবার পেছনে চলে যাবে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/জেএইচ


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com